শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সামনে আরো ভয়াবহ বিপদ

আপডেট : ১৩ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৪০

দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিধিনিষেধ আরোপের পরেও সংক্রমণ, মৃত্যুর হার ঊর্ধ্বমুখী থাকায় সংকট আরো বাড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে চিকিত্সা এবং জরুরি সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো।

কোনো হাসপাতালে বেড খালি নেই, অক্সিজেন সংকট, আইসিইউ শয্যা খালি নেই। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, সামনে আরো ভয়াবহ বিপদ। এভাবে যদি রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে আর সংক্রমণ রোধ না করা যায়, তাহলে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত হাসপাতালে যে পরিমাণ রোগী চিকিত্সাধীন আছে কিংবা আক্রান্ত হয়েছে তাদের সামাল দিতে কয়েক মাস সময় লাগবে। এরপর যদি বাড়তে থাকে তাহলে রোগী সামাল দেওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। আক্রান্তের সংখ্যা কমাতে না পারলে পরিস্থিতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তাই বাঁচতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা আরো বলেন, করোনা মহামারির এই কঠিন দুঃসময়ে সুস্থ থাকা এবং বেঁচে থাকার দায়িত্ব আসলে যার যার নিজের। বাঁচার সহজ উপায় হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। সচেতনভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে করোনা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। আর এটাই একমাত্র উপায়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। এটা প্রত্যেকের নাগরিক দায়িত্বও বটে। কারণ ব্যক্তি সুস্থ থাকলে তার পরিবার এবং পরিপার্শ্বও নিরাপদ থাকবে। তাতে ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হবে। করোনা ভাইরাস থেকে সুরক্ষায় হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ও ভিড়ের মধ্যে মাস্ক পরাই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। বর্তমানে প্রতিদিন যে হারে করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে, যে সংখ্যায় মানুষের মৃত্যু হচ্ছে—এটা দুশ্চিন্তার বিষয়। তাই স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে আবেগের প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আবেগের প্রশ্রয় দেওয়া মানেই হবে বিপদের ঝুঁকি নেওয়া—যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, একই চিকিত্সা জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে থাকলেও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর সারা দেশ থেকে মানুষ ঢাকায় চলে আসে। এ কারণে ঢাকায় রোগীর প্রচণ্ড চাপ।

ঢাকার বাইরে চিকিত্সাসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিচালক, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ও সিভিল সার্জনদের। কিন্তু তারা এ দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। সারা দেশে চিকিত্সা ব্যবস্থার নিয়মিত মনিটরিংয়ের অংশ হিসেবে গতকাল সচিবালয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে দেশের সব সরকারি হাসপাতালের পরিচালক ও বিভাগীয় পরিচালকদের (স্বাস্থ্য) সঙ্গে কথা বলেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। করোনা রোগীরা নিজ নিজ জেলা ও বিভাগীয় শহরের হাসপাতালে চিকিত্সাসেবা নেবে—এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ও সিভিল সার্জনদের নির্দেশ দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, রোগী খুবই ক্রিটিক্যাল হলে জেলা শহরে কিংবা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠাবেন। সেখানে সব ব্যবস্থা আছে। কাউকে ঢাকায় পাঠাবেন না। সভায় অন্যানের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব লোকমান হোসেন মিয়া, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা আর কত বলব, বলার কিছু নেই। আমাদের চেয়ে বেশি বোঝেন লোকজন। তারা স্বাস্থ্যবিধি মানেন না। তিনি বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। বাঁচতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনা হলে সময়মতো চিকিত্সাসেবা নিতে হবে। কিন্তু রোগীরা অবহেলা করে সাত-আট দিন পরে আসছে। এক্ষেত্রেও রোগীদের আরো দায়িত্বশীল হতে হবে।

মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, দৈত্যের মতো আকার ধারণ করেছে করোনা। সংক্রমণ বাড়ছেই। গতকাল পর্যন্ত করোনার যে অবস্থা আছে তা সামাল দিতে ছয় মাস পর্যন্ত লাগবে। আজ থেকে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে সামনে আরো ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। হাসপাতালে শয্যা খালি নেই, অক্সিজেন ও আইসিইউ বেড সংকট। মৃত্যু বাড়ার কারণ সময়মতো চিকিত্সাসেবা না পাওয়া। তিনি বলেন, করোনা প্রতিরোধের সহজ কাজ হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। কিন্তু আমরা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছি। এ রোগের পরিপূর্ণ চিকিত্সা নেই। বিশ্বব্যাপী চলছে উত্সর্গভিত্তিক চিকিত্সা। তাই বাঁচতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও নিপসনের সাবেক পরিচালক ডা. আব্দুর রহমান বলেন, বর্তমানে দেশে করোনার যে ধরন ছড়িয়েছে, তা খুবই ক্ষিপ্ত গতির। এটা থেকে রক্ষা পেতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এটি ফরজ কাজ। দেশের স্বার্থে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর থেকে কঠোরতর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। ডা. আব্দুর রহমান বলেন, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় কোনো কোনো ওষুধ কোম্পানি এন্ট্রি-ভাইরাল ওষুদের দাম বৃদ্ধি করেছে। সরকারকে এ বিষয়টির প্রতি নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

এ এম জেড হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ সায়েম বলেন, বর্তমানে ৭০ ভাগ করোনা রোগী হাসপাতালে আসেন ক্রিটিক্যাল অবস্থায়। জ্বর হওয়ার সাত-আট দিন পরে আসলে দেখা যায় রোগীর ৭০ ভাগ ফুসফুস নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিদিন শতাধিক করোনা রোগীকে চিকিত্সাসেবা দিচ্ছেন ডা. মোহাম্মদ সায়েম। তিনি বলেন, জ্বর হলে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আর বাঁচতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানা ছাড়া কোনো গতি নেই।

এদিকে দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর দিন যত গড়াচ্ছে মৃত্যুর সংখ্যা ততই বাড়ছে। আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির গতিও কমছে না। সংক্রমণ এড়াতে কঠোর বিধিনিষেধ শুরুর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল সোমবার ৮৩ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে, যা এই যাবত্কালের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যা। এ নিয়ে টানা তিন দিন মৃত্যুর একের পর এক রেকর্ড হয়েছে। এর আগে শনিবার ৭৭ মৃত্যুর রেকর্ড গড়ার পরদিন রবিবারই ৭৮ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সোমবার সেই সংখ্যাও ছাড়িয়ে গেল। গত ৩১ মার্চ ৫২ জনের মৃত্যুর খবর দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর থেকে দৈনিক মৃত্যু কখনোই ৫০ এর নিচে নামেনি। বরং বাড়তে বাড়তে এই প্রথম ৮০ ছাড়াল। দেশে এ নিয়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ৯ হাজার ৮২২ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত ২৪ ঘণ্টায় ৭ হাজার ২০১ জন নতুন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের খবর জানিয়েছে। গত কয়েক দিন ধরেই দিনে ৬ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়ে আসছিল। এর মধ্যে গত বুধবার রেকর্ড ৭ হাজার ৬২৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। মধ্যে খানিক কমলেও নতুন রোগীর সংখ্যা আবার ৭ হাজার ছাড়াল। সব মিলিয়ে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৯১ হাজার ৯৫৭ জন। করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যু ও আক্রান্ত ঢাকায়, দ্বিতীয় চট্টগ্রাম।

ইত্তেফাক/এসএ