বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অর্ধেকই বন্ধ

আপডেট : ০৬ মে ২০২১, ১৪:৫১

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা খাতের মধ্যে আর্থিক ক্ষতিতে এগিয়ে আছে কিন্ডারগার্টেন। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো, উদ্যোক্তারা হয়েছেন নিঃস্ব, আর চাকরি হারিয়েছেন শিক্ষকরা। এমন পরিস্থিতিতে এখনো যারা টিকে আছেন, তারাও অন্য পেশায় ফিরে যাবার চিন্তা করছেন। কিন্ডারগার্টেন মালিকরা বলছেন, এমন অবস্থা চলতে থাকলে কিন্ডারগার্টেন নামটিই হয়তো এক সময় হারিয়ে যাবে।

কিন্ডারগার্টেন ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী দেশে বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা ছিল ৬০ হাজারের বেশি। শিক্ষার্থী ছিল ৮০ লাখেরও বেশি। আর শিক্ষক ছিল ১০ লাখ। বিভাগীয় শহরসহ বিশেষ করে রাজধানীর অলিগলিতে বাসাভাড়া করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল এই স্কুলগুলো। আশপাশে তাকালেই মিলত কিন্ডারগার্টেনের সাইনবোর্ড, যা এখন আর তেমন দেখা যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিন্ডারগার্টেন মালিক ও শিক্ষকদের অধিকাংশই এখন অনেকটা ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। যে সব উদ্যোক্তা আর্থিকভাবে সচ্ছল তারা অন্যদের সহায়তা করছেন।

কিন্ডারগার্টেন মালিকরা বলছেন, রাজধানীসহ সারা দেশের নামীদামী স্কুলগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম সাধারণত প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু হয়। আর বেশির ভাগ সরকারি মাধ্যমিকে কার্যক্রম শুরু হয় তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণি থেকে। এর আগ পর্যন্ত অভিভাবকদের অন্যতম পছন্দ কিন্ডারগার্টেন। প্লে, নার্সারি, কেজিসহ বিভিন্ন শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়। তবে উল্লেখিত তিন শ্রেণিতেই মূলত শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি থাকে। কিন্তু এই শ্রেণিগুলোতে এবারে ভর্তি প্রায় শূন্যের কোঠায়। তথ্য অনুযায়ী, এসব শ্রেণিতে নভেম্বর-ডিসেম্বরে শিশু শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়। আর জানুয়ারিতে ক্লাস শুরু হয়। করোনার কারণে নতুন কোনো শিক্ষার্থীই ভর্তি হয়নি এসব শ্রেণিতে। আর অন্যান্য শ্রেণিতে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি ছিল তারাও এখন আর ক্লাস চালিয়ে যেতে আগ্রহ দেখায়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় টিউশন ফি গুনতে নারাজ বেশির ভাগ অভিভাবক।

কিন্ডারগার্টেন পড়ুয়া বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে টিউশন ফি দেয়নি। এমনটি তারা স্কুলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই রাখছে না। কারণ তারাও মনে করছে, যোগাযোগ করলে যদি বকেয়া টিউশন ফি দিতে হয়। এ জন্য সবাই সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করছে। আর টিউশন ফি না পাওয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীদেরও বেতন নেই ১৪ মাস ধরে।

কিন্ডারগার্টেন মালিকরা শিক্ষক-কর্মচারীদের জানিয়ে দিয়েছেন, বেতন-ভাতা দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই এই সময়ে চাকরিও নেই। যদি কখনো স্কুল খোলে তখন থেকে আবার বেতন-ভাতা দিতে পারব।

কিন্ডারগার্টেনের ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর বেশির ভাগই পেশা পরিবর্তন করেছেন। কেউ কেউ ছোটখাটো নানা কাজ করে বহু কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করছেন। আবার কেউ গ্রামে ফিরে গেছেন।

হান্নান তালুকদারের ইচ্ছা ছিল তার পাঁচ বছর বয়সী সন্তানকে এবছর কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করাবেন। কিন্তু করোনার কারণে ভর্তি করাননি। তিনি জানান, আগামী বছর অন্য কোনো ভালো স্কুলে ভর্তি করার চিন্তা করছি। হান্নান তালুকদারের সন্তান এখন তাই ঘরে বসেই সময় কাটাচ্ছে।

কয়েকজন কিন্ডারগার্টেন মালিক এই প্রতিবেদককে জানান, ৬০ হাজার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্ধেক বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের পরিচিত যারা ছিলেন তারা কেউ আর এখন এই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত নেই। বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন, টেবিল বেঞ্চসহ অন্যান্য আসবাবপত্র যা ছিল তা গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন বা কেউ বিক্রি করে দিয়েছেন। আবার কেউ ভাড়ার পরিবর্তে বাড়ির মালিককে সব দিয়ে গেছেন। অনেকে এই পেশা থেকে স্থায়ীভাবে সরে গেলেও কৌশলগত কারণে তা প্রকাশ করছেন না। যদি কোনো সরকারি সহায়তা পাওয়া যায়, তখন আবার এ কাজে ফিরে আসবেন—এই আশায় আছেন তারা।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী ও কিন্ডারগার্টেন মালিকরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে তারা কোনোমতে বেঁচে আছেন। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা পেলাম না আমরা। তিনি জানান, ১০ হাজার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। যাদের নিজেদের পুঁজি ছিল, তারা তা ভেঙে কোনোরকমে স্কুল টিকিয়ে রেখেছেন।

আর কিন্ডারগার্টেন মালিকদের পৃথক সংগঠন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, খুবই মানবেতর জীবন চলছে সবার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে বেঁচে যেতেন কিন্ডারগার্টেনের মালিক ও শিক্ষকরা। কিন্তু এই সেক্টরের সামনে হয়তো আরো দুর্দিন অপেক্ষা করছে।

ইত্তেফাক/এমআর