শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিরোধীদলীয় নেতা-উপনেতা বিষয়ে এই প্রথম আইন হচ্ছে

আপডেট : ১১ জুন ২০২১, ১০:৩৪

জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও বিরোধীদলীয় উপনেতার বিষয়ে দেশে প্রথমবারের মতো আইন হতে যাচ্ছে। বর্তমানে পূর্ণমন্ত্রীর পদমর্যাদার ‘বিরোধীদলীয় নেতা’ মনোনীত হন সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী। আর প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার ‘বিরোধীদলীয় উপনেতা’ নির্বাচিত হয়ে থাকেন ১৯৭৯ সালের অধ্যাদেশের বলে।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে অধ্যাদেশটি রহিত করে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ‘জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও বিরোধীদলীয় উপনেতা (পারিতোষিক ও বিশেষাধিকার) বিল, ২০২১’ নামে বিলটি সংসদে চলতি বাজেট অধিবেশনেই উত্থাপনের জোর সম্ভাবনা রয়েছে। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল বৃহস্পতিবার ইত্তেফাককে বলেন, ‘বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতার বিষয়ে ১৯৭৯ সালের যে অধ্যাদেশ রয়েছে সেটি রহিত করে আইন প্রণয়নের জন্য সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। এমনকি আইনটি বাংলায় করার কথাও বলা হয়েছে আদালতের আদেশে। আদালতের রায়ের আলোকেই আইনটি করা হচ্ছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী জানান, সংসদের চলমান অধিবেশনেই বিলটি তোলা হতে পারে।

‘জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও বিরোধীদলীয় উপনেতা (পারিতোষিক ও বিশেষাধিকার) বিল, ২০২১’ এর খসড়ায় গত ৩১ মে নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিসভার ঐ বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান, ১৯৭৯ সালের অধ্যাদেশটি বাতিল করে আইনে রূপান্তরের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। তবে আইনের খসড়ায় তেমন কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, বিরোধীদলীয় উপনেতা কে হবেন; কীভাবে হবেন—সেটির ব্যাখ্যা স্পষ্ট করা হয়েছে খসড়ায়।

বিরোধীদলীয় নেতা বা উপনেতার বিষয়ে দেশের সংবিধানেও কিছু বলা নেই। তবে ‘বিরোধীদলীয় নেতা বা উপনেতার (পারিতোষিক ও বিশেষাধিকার) অধ্যাদেশ-১৯৭৯’-এ তাদের পারিতোষিক ও মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতার স্বীকৃতি দেওয়ার একক ক্ষমতা সংসদের স্পিকারের।

বিরোধীদলীয় নেতা মনোনয়নের বিষয়ে সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ২(১)(ট) বিধিতে বলা হয়েছে, “‘বিরোধীদলের নেতা’ অর্থ স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমত দল বা অধিষঙ্গের নেতা”। তবে কার্যপ্রণালী বিধিতে বিরোধীদলীয় উপনেতার বিষয়ে কিছু বলা নেই।

বিরোধীদলীয় নেতা বা উপনেতার (পারিতোষিক ও বিশেষাধিকার) অধ্যাদেশ-১৯৭৯ বলেই বিরোধীদলীয় নেতা মন্ত্রী এবং উপনেতা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। গত ৩১ মে মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, বিরোধীদলীয় উপনেতা কে হবেন; কীভাবে হবেন সেটির ব্যাখ্যা স্পষ্ট করা হয়েছে নতুন করে হতে যাওয়া আইনের খসড়ায়। তবে আইনমন্ত্রী গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমার জানা মতে আইনের খসড়ায় বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতার বেতন-ভাতাদি সম্পর্কে বলা আছে, সেখানে তাদের নিয়োগ বা মনোনয়ন প্রক্রিয়ার বিষয়ে কিছু নেই’।

প্রচলিত নিয়ম ও বিধিবিধান অনুযায়ী, জাতীয় নির্বাচন শেষে সংসদ গঠনের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পাওয়া রাজনৈতিক দল সংসদে প্রধান বিরোধীদল হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। প্রধান বিরোধীদলের পার্লামেন্টারি পার্টি বৈঠকের মাধ্যমে বিরোধীদলীয় নেতা ও উপনেতা মনোনীত করে থাকে। সেটি সংশ্লিষ্ট দলের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে সংসদের স্পিকারকে জানাতে হয়। পরবর্তী সময়ে স্পিকার কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন।

তবে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও বিরোধীদলীয় উপনেতা মনোনয়নে সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা জটিলতার সৃষ্টি হয়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর বর্তমান সংসদের প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রয়াত চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ দলের পার্লামেন্টারি পার্টির কোনো বৈঠক ছাড়াই ২০১৯ সালের ৪ জানুয়ারি গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে ঘোষণা দেন যে, দলের পদাধিকার বলে তিনিই হবেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা এবং তার ভাই জি এম কাদের হবেন বিরোধীদলীয় উপনেতা। পরদিন এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে চিঠি দিয়েছিলেন এরশাদ।

এরপর ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা ও জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেন স্পিকার। তবে একই বছরের ২২ মার্চ স্পিকারকে দেওয়া চিঠিতে জি এম কাদেরের পরিবর্তে রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় উপনেতা করার অনুরোধ জানান এরশাদ। পরদিন ২৩ মার্চ রওশনকে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেন স্পিকার।

তবে ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর বিরোধীদলীয় নেতা ও বিরোধীদলীয় উপনেতা হওয়া নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিবাদ দেখা দেয় জাপায়। ঐ বছরের ৩ সেপ্টেম্বর জি এম কাদের তাকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানান স্পিকারকে। পরদিন স্পিকারকে পালটা চিঠি দিয়ে জি এম কাদেরের চিঠি আমলে না নিতে অনুরোধ জানান রওশন এরশাদ। পরবর্তী সময়ে জাপায় সমঝোতা হয় যে, রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা ও জি এম কাদের বিরোধীদলীয় উপনেতা হবেন। সেই অনুযায়ী স্পিকারকে নতুন করে চিঠি দেওয়া হয়।

২০১৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সংসদ সচিবালয়ের প্রজ্ঞাপনে রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা ও জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে স্পিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার কথা জানানো হয়। ঐ প্রজ্ঞাপনে সেদিন বলা হয়েছিল, ‘জাতীয় সংসদের সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য নিয়ে গঠিত সংসদীয় দলের নেতা রওশন এরশাদকে (ময়মনসিংহ-৪) জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি ২(১)(ট) অনুযায়ী বিরোধী দলের নেতা এবং এক উপনেতা (পারিতোষিক ও বিশেষাধিকার) অধ্যাদেশ ১৯৭৯ মোতাবেক লালমনিরহাট-৩ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য গোলাম মোহাম্মদ কাদেরকে উপনেতা হিসেবে স্পিকার স্বীকৃতি দিয়েছেন।’

ইত্তেফাক/এসআই