মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ডাক্তার তুমি কার (পর্ব-২) 

উপঢৌকন নিয়ে ব্যবস্থাপত্রে নিম্নমানের ওষুধের নাম লেখেন চিকিৎসকরা

আপডেট : ২৭ জুন ২০২২, ১৭:৫১

দুপুর ১ টায় (৬ জুন )  রাজধানীরে একটি বেসরকারী হাসপাতালের  দ্বিতীয় তলায় গাইনি, শিশু, চর্ম ও যৌন বিভাগের সামনে রোগীদের ভিড়।। অনুসন্ধান করে দেখা গেল উপস্থিত সবাই রোগী নয়, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মেডিকেল প্রমোশন অফিসার (এম.পি.ও)।

দেখা গেল বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির এসব মেডিকেল প্রমোশন অফিসাররা দায়িত্বরত ডাক্তারদের নানা কৌশলে কেউ দিচ্ছেন খামের ভেতরে করে তার প্রাপ্য কমিশন, কেউ দিচ্ছেন দামি মোবাইল আবার কেউবা দিচ্ছেন দামি উপহার। এমন চিত্র দেখা গেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ দেশের প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে।

চিকিৎসকদের কমিশন বাণিজ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন মেডিকেল প্রমোশন অফিসার বলেন, ‘আমরা সব হাসপাতালের স্বনামধন্য ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের প্রথমে তালিকা করি। তাদেরকে নানা উপায়ে বিভিন্ন দামি উপহার এমনকি ঘর সাজানোর সামগ্রী ডাক্তারদের বাসায় দিয়ে আসি। তারপর ডাক্তারদের সঙ্গে এক ধরণের মৌখিক চুক্তি করি। তারা রোগীদের প্রেসক্রিপশনে আমাদের কোম্পানির ওষুধ লিখবে। তার বিনিময়ে ডাক্তাররা মাসিক কমিশন ও দামি উপহার পাবেন। এমনকি ডাক্তারদের বিদেশ ভ্রমণ করানো হয়।’

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ডাক্তার বলেন, ‘অনেক ডাক্তার আর্থিক সুবিধা, বিদেশ ভ্রমণ ও স্পন্সর সুবিধা নিয়ে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের নির্ধারিত ওষুধ লিখে থাকে। অনেক সময় নাম নিম্ন মানের ওষুধ লিখতে বাধ্য হতে হয়।’ 

এ সব কারণে অনেক রোগী আক্ষেপ করে বলেন, ‘বর্তমান ডাক্তাররা রোগীদের জন্য না। তারা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ ও ওষুধ কোম্পানির মালিকদের জন্য।’

মেডিকেল প্রমোশন অফিসার ও ডাক্তারদের কমিশন বাণিজ্য বিষয়ে জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুরকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। 

মেডিকেল প্রমোশন অফিসার নাজমুল আলম বলেন, ‘কিছু কিছু হাসপাতালে আমাদের প্রবেশ না করার জন্য বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা সত্ত্বেও আমরা সেখানে প্রবেশ করছি। রোগীদের প্রেসক্রিপশনে দেখি সেখানে আমাদের ওষুধগুলো আছে কী  না তা দেখি। সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য রোগীদের প্রেসক্রিপশনের ছবি আমরা কৌশলে তুলে রাখি।’

ভুক্তভোগী হৃদয় চৌধুরী বলেন, ‘আমি আমার ছোট বাচ্চাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছিলাম। আমার বাচ্চার কিছু সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে শরীরে ঘামাচির রয়েছে। সেটা বলায় ডাক্তার আমার মেয়ের প্রেসক্রিপশনে ১৪’শ টাকার একটি বডি ওয়াশ দিয়ে দেন। সাথে দামি দামি ভিটামিন সিরাপও দেন।’

আরেকজন ভুক্তভোগী সায়মা আহসান বলেন, ‘আমার কিছু সমস্যা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কিন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম তিনি আমার রোগের উপসর্গ শুনে বেশ কিছু ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ও অ্যান্টিবায়োটিক মেডিসিন দেন। যা খুবই ব্যয়বহুল। যেগুলো শাহাবাগে পাওয়া যায়, কিন্তু স্থানীয় ফার্মেসীগুলোতে তা পাওয়া যায় না।’

রোগীদের প্রেসক্রিপশনে অহেতুক ঔষধ বা দামি ওষধ দিচ্ছে কেনো তা জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাবেক স্কিন বিশেষজ্ঞ অধ্যক্ষ বশির আহমেদ বলেন, ‘রোগীদের উপসর্গ দেখে সাধারণত আমরা ওষুধ দিয়ে থাকি। সেখানে কোনটা দামি কোনটা কম দামি ওষধ সেটা মুখ্য নয়। তবে কিছু কিছু ডাক্তার ইচ্ছাকৃতভাবে বা অহেতুক ঔষধ লিখে থাকেন নিজের বা কোম্পানির স্বার্থে।’

একই বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার. জেনারেল ডা. মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমি এখানে নতুন জয়েন করেছি। মেডিকেল প্রমোশন অফিসারের প্রবেশে আমাদের প্রতিষ্ঠানে কিছু নিয়ম কানুন আছে। তাছাড়া আমরা নতুন নিয়ম করতে যাচ্ছি- এখন থেকে মেডিকেল প্রমোশন অফিসাররা শুধু শনি ও মঙ্গলবার দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত ডাক্তারদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। যদি তারা এই নিয়ম মেনে না চলে তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’ 


ইত্তেফাক/ইউবি
 

এসজেড