মহামারি করোনাকালে বিশ্বে নারীর প্রতি সহিংসতার নানা ধরনের মধ্যে আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়েছে অনলাইনে যৌন হয়রানি বা সাইবার বুলিং। সাইবার বুলিংয়ে শিকার হয়ে হতাশা আর উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন অসংখ্য নারী। গত পাঁচ-সাত বছরে ঘরে বসে নারীদের অনলাইনে পণ্য বেচা-কেনার প্রসার যেমন বেড়েছে, তেমনি তৃণমূলের নারীদেরও অনলাইনে সরব দেখা যায় অনলাইন ব্যবসার কারণে। ফলে শহর থেকে গ্রাম কিংবা স্বল্প থেকে উচ্চশিক্ষিত অধিকাংশ নারীকেই অনলাইনে সরব থাকতে দেখা যায়। ফলে ফেসবুক, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ বা ইউটিউবে তাদের বিচরণ আগের চেয়ে অনেক বেশি।
গবেষণা তথ্যে জানা যায়, দেশের ৭১ শতাংশ নারী সাইবার বুলিংয়ের শিকার। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সাইবার বুলিংয়ের শিকার পাঁচ জন নারীর মধ্যে এক জন আত্মহত্যা করেন। দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীসহ ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের তিন-চতুর্থাংশ নারীই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। দেশের প্রায় ১২ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে উল্লেখ সংখ্যক নারী। এর উল্লেখ সংখ্যকই অনলাইন ব্যবহার করতে গিয়ে প্রায় হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।
ইউনিসেফের ২০১৯ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ৩৮ শতাংশ ১০ থেকে ১৩ বছর বয়সের, ৩৬ শতাংশ ১৪ থেকে ১৫ বছর এবং ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সী ২৫ শতাংশ। ঢাকায় অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীদের ৭০ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের জরিপে দেখা গেছে, অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন, চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন কিংবা স্বাধীন চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন, এমন নারীর সংখ্যা ৩২ শতাংশ। অনলাইনে নিরাপত্তাহীনতায় পড়েছেন ২৫ শতাংশ এবং সামাজিকভাবে হেয় হয়েছেন ১৭ শতাংশ নারী।
একজন বিক্রেতা নারী ভিডিও লাইভে এসে যখন তার পণ্য বিক্রির জন্য ফেসবুকে লাইভ করেন, তখন কমেন্টস বক্সে দেখা যায় অসংখ্য আইডি থেকে তাকে বিভিন্ন ভাবে হয়রানি করা হয়। তাকে তার কাজ থেকে সরে যেতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। তাকে অশালীন ভাষা ব্যবহারে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এটা করছে নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয়, এমন এক শ্রেণির মানুষ।
সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞজন বলছেন, সাইবার বুলিংয়ের শিকার নারীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অভিযোগের মধ্যে পর্নোগ্রাফি, ব্ল্যাকমেইল, ফেসবুক আইডি হ্যাক, অর্থ আদায় এবং হত্যার হুমকি উল্লেখযোগ্য। তারা বলছেন, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, তুচ্ছ ঘটনায় সম্পর্ক নষ্ট করা, ডিজিটাল প্ল্যাটফরম সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় এসব ঘটনা বারবার ঘটছে। তারা বলছেন, মূল সমস্যা সামাজিক অবক্ষয়। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোথাও নৈতিকতার শিক্ষা দেওয়া হয় না। এমনকি পরিবারেও তা নেই। যতদিন পর্যন্ত মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ না বাড়বে ততদিন পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, নারীদের সম্মান ও সমতার চোখে দেখার ধারণা মূলত সমাজ থেকে উঠে আসতে হয়। সমাজ এখনো সবাইকে সে শিক্ষা দিতে পারছে না। নারীকে এখনো সমাজে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের দৃষ্টিতে দেখা হয়। নারীকে এই ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার অবস্থা যতদিন পরিবর্তন না হবে ততদিন পরিস্থিতির উন্নতি আশা করাটা দুরাশা।
ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি বিভাগের উপ-কমিশনার আ ফ ম আল কিবরিয়া বলেন, সাইবার বুলিংয়ে জড়িত অনেককেই তারা আইনের আওতায় এনেছেন, অপরাধের গুরুত্ব বুঝে মামলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। তার মতে, পুলিশের কাছে তরুণীদের যত অভিযোগ আসে তার অধিকাংশই প্রেমঘটিত সাইবার ক্রাইম। এসব ক্ষেত্রে তরুণীদের আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সাইবার ক্রাইম এখন যে পর্যায়ে চলে গেছে লজ্জা আর ভয় পেয়ে থাকলে চলবে না। হয়রানির শিকার হলে ভুক্তভোগীদের তিনি পুলিশের কাছে অভিযোগ করার অনুরোধ জানান।
ইত্তেফাক/এসআই