মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কোভিড-পরবর্তী মানব পাচারের ঝুঁকি বেড়েছে

আপডেট : ০৪ আগস্ট ২০২১, ০৭:৪৯

করোনাকালে মানব পাচারের ঝুঁকি বেড়েছে। এই মহামারিতেও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করছে যেসব দেশের মানুষ, তাদের শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ৩ হাজার ৩৩২ জন বাংলাদেশি এভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। আর গত এক যুগে ইউরোপে গেছেন অন্তত ৬২ হাজার মানুষ। এমন তথ্য জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্য বলছে, এভাবে যারা ইউরোপে যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪০। অবশ্য শুধু ইউরোপ নয়, করোনা মহামারির মধ্যেও শ্রম অভিবাসনের নামে মানব পাচার কিংবা ভারতে নারী-কিশোরী পাচার কোনোটাই থেমে নেই। বরং এসব ক্ষেত্রে এখন সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম ব্যবহার করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিড মহামারির আগেও বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬ থেকে ৭ লাখ লোক বৈধভাবে বিদেশে গেছেন। কিন্তু গত বছরের মার্চে মহামারি শুরুর পর সেই সংখ্যা ২ লাখে নেমে আসে। ফলে সামনের দিনগুলোতে লোকজন বিদেশে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। ফলে অনিয়মিত অভিবাসন ও মানব পাচারের ঝুঁকি বাড়তে পারে। দুবাইতে ভিজিট ভিসায় লাখো বাংলাদেশির গমন এবং ইউরোপে মরিয়া হয়ে প্রবেশের চেষ্টা তারই ইঙ্গিত দেয়। সামনের দিনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসহ সবাইকে অনিয়মিত অভিবাসন ও মানব পাচার বন্ধে আরো সক্রিয় হতে হবে।

ছবি: সংগৃহীত

প্রসঙ্গত, চলতি বছর ২০২১ সালের গত ২১ জুন এভাবে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে ১৭ বাংলাদেশি প্রাণ হারান। তিউনিসিয়ার কোস্ট গার্ড ভূমধ্যসাগর থেকে বাংলাদেশিসহ ৩৮০ জনকে জীবিত উদ্ধার করে। এর আগে গত ২৪ জুন ২৬৭ জনকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার কোস্ট গার্ড, যার মধ্যে ২৬৪ জনই বাংলাদেশি। আর ১০ জুন ১৬৪ বাংলাদেশিকে তিউনিসিয়া উপকূল থেকে উদ্ধার করে দেশটির কোস্ট গার্ড।

পাচারের শিকার বাংলাদেশিদের কাছ থেকে জানা যায়, দুবাই এবং ওমানে নতুন আসা বাংলাদেশি তরুণরাই মূলত পাচারকারীদের প্রধান টার্গেট। দুবাই এবং ওমান থেকে তাদের নিয়ে আসা হয় ওমানের মাসকট বন্দরে। সেখান থেকে স্পিডবোটে ওমান উপসাগর অতিক্রম করে নিয়ে যায় ইরানের বন্দর আব্বাসে। তারপর ইরানের বিভিন্ন শহর ও জঙ্গলে আটক রাখে। সেখান থেকে ইরাক ও তুরস্ক হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করার চেষ্টা চলে। এভাবে যাওয়ার সময় অনেকেই ইরানে আটক হচ্ছেন।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, বাংলাদেশ আজ সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার দিক থেকে প্রথম। এটি আমাদের জন্য লজ্জার। গত এক দশকে ৬২ হাজার লোক এভাবে ইউরোপে গেছে। আবার শ্রম অভিবাসনের নামে ভিজিট ভিসায় দুবাই যাচ্ছে লোকজন। ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে নারী ও কিশোরীরা। অন্যদিকে রোহিঙ্গারাও পাচার হয়ে যাচ্ছে। পাচার প্রতিরোধে আমাদের মানুষকে যেমন সচেতন হতে হবে তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে, সেই সঙ্গে মামলাগুলোর বিচার হতে হবে।

ছবি: সংগৃহীত

ব্র্যাকের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, গত কয়েক বছরে ইউরোপ ও লিবিয়া থেকে ফেরত আসা ২ হাজার ২৮৪ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একেক জন এভাবে ইউরোপে যেতে ৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ করেছেন। বাংলাদেশ থেকে মোট ১৮টি রুটে লোকজন ইউরোপে যাওয়ার কম-বেশি চেষ্টা করছেন। বাংলাদেশিরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে, যেটি সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট হিসেবে পরিচিত।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, মানব পাচার মানবাধিকরের চরম লঙ্ঘন। পাচারকারীদের প্রতিহত করতে হবে। তিনি বলেন, এত এত পাচারকারী অথচ মানব পাচার আইনে ৯ বছরে মাত্র ৩৬টা মামলায় মাত্র ৭১ জনের সাজা হলো কেন? অপরাধীদের বিচার করতে হবে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম বলেন, জেনে বুঝে দক্ষ হয়ে বিদেশে যেতে হবে। প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। একইভাবে যারা দায়িত্ব পালন করেন সেই সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ সবার মানব পাচার ও অভিবাসন আইনের বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ দরকার।

ইত্তেফাক/এএএম