শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দেশের পতাকাবাহী জাহাজ অপ্রতুল, সম্ভাবনা হাতছাড়া

আপডেট : ১২ অক্টোবর ২০২১, ০৪:৪৪

প্রতি বছরই বাড়ছে সমুদ্রপথে জাহাজে দেশের আমদানি-রপ্তানি। দেশের অন্যতম সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে কনটেইনারজাত এবং ব্রেকবাল্ক পণ্যের হ্যান্ডলিং বছর বছর রেকর্ড ভাঙছে। কিন্তু দেশের আমদানি পণ্য কিংবা রপ্তানি পণ্য পরিবহন করে দেশের অর্থ দেশে রাখার জন্য কাঙ্ক্ষিত সংখ্যায় বাড়েনি বাংলাদেশের পতাকাবাহী সরকারি-বেসরকারি সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা।

শিপিং সেক্টরের ব্যবসায়ী এবং কারিগরি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা অপ্রতুল। এর সংখ্যা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। এর জন্য অনুকূল সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে সরকারকে।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক (চট্টগ্রাম বন্দর বিষয়ক) খায়রুল আলম সুজন ইত্তেফাককে বলেন, প্রতি বছর ৫ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার পণ্যবাহী সমুদ্রগামী জাহাজ পণ্য পরিবহনে চট্টগ্রাম বন্দরসহ দেশের সমুদ্র বন্দরগুলোতে এসে থাকে। কিন্তু সেই তুলনায় বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা ৭৫টি, যা নেহায়েতই অপ্রতুল। ফলে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে বিদেশি জাহাজ ভাড়া করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের অর্থনৈতিক মন্দা কেটে যাওয়ার পরপরই গত বছর থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে সমুদ্রগামী জাহাজের ভাড়া রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে গেছে। এই সময়েও সংখ্যার অপ্রতুলতার কারণে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ কনটেইনারজাত এবং খোলা পণ্য পরিবহনে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ হারাচ্ছে।

ঢাকাস্থ নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার কে এম জসিমউদ্দিন সরকার ইত্তেফাককে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের পতাকাবাহী কোনো কনটেইনার জাহাজ ছিল না। সরকারি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বিএসসির মেয়াদোত্তীর্ণ বাংলার মুখ ও বাংলার রবি স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি হয়ে যাওয়া পর বাংলার মণি নামের বিএসসির একটি মাল্টি পারপাস জাহাজ ১৯৯২ সালের দিকে কনটেইনার ও বিভিন্ন ধরনের পণ্য পরিবহন করেছে। মণি বসে যাওয়ার পর এইচআরসির দুটি জাহাজ কিছুদিন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ফিডার সার্ভিসে চলাচল করেছে। এইচআরসির জাহাজগুলোও বসে যাওয়ার পর ফিডার সার্ভিসে প্রায় দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের পতাকাবাহী আর কোনো কনটেইনার জাহাজ ছিল না। গত দুয়েক বছরের মধ্যে কর্ণফুলী লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি সংস্থা ছয়টি সমুদ্রগামী কনটেইনারবাহী জাহাজ সংগ্রহ করে ফিডার সার্ভিসে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কেলাং, কলম্বো ইত্যাদি গভীর সমুদ্রবন্দরে পণ্য বোঝাই কনটেইনার বহন শুরু করলে সেই শূন্যতা কিছুটা দূর হয়।

দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্র জাহাজ রফতানি হলো জার্মানিতে

তিনি বলেন, এছাড়া দেশের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বিভিন্ন ধরনের বাংলাদেশের পতাকাবাহী নিজস্ব জাহাজ রয়েছে। সেগুলো তাদেরই প্রয়োজনে ব্যবহূত হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর দিয়ে বর্তমানে প্রতি বছর পণ্য পরিবহনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টন থেকে প্রায় ১১ কোটি টন। বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজগুলো পরিবহন করতে পারছে বছরে সেসব পণ্যের ৮ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশ মাত্র। কিন্তু পরিবহন করার কথা ছিল মোট পণ্যের ৫০ শতাংশ, অর্থাত্ মোট পণ্যের পরিমাণের সাড়ে ৩ কোটি টন থেকে সাড়ে ৫ কোটি টন। তিনি বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ফ্ল্যাগ প্রটেকশন আইন ২০১৯-এর বিধিমালাগুলো ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব করে সহজীকরণের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বিধিমালার সেসব প্রটেকশন বেনিফিট নিতে হলে দেশের পতাকাবাহী অনেক জাহাজ দরকার বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তবে এই ক্ষেত্রে অভিজ্ঞদের এগিয়ে আসা দরকার বলেও তিনি জানান।

চট্টগ্রামস্থ মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন ইত্তেফাককে বলেন, দেশের সমুদ্র বাণিজ্যে বাংলাদেশের পতাকা নিবন্ধনের মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। কারণ উদ্যোগের অভাবে দেশের বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাপূর্ণ এই সেক্টরের সুফল বাংলাদেশ পাচ্ছে না। কেউ যদি নতুন জাহাজ নামাতে আসেন, তাকে সরকারি সকল আইন প্রতিপালন করেই স্বল্পতম সময়ে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে। এছাড়া দেশের পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা বাড়লে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে থেকে যাবে, দেশের অভিজ্ঞ জনশক্তি বিদ্যমান আইন অনুসারেই সেসব জাহাজে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ পাবেন। এমনকি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের রেগুলেশন অনুসারে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজের বার্থিংও সবার আগে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেওয়ার আইন আছে।

শিপার্স কাউন্সিলের একটি সূত্র জানায়, দেশের তিনটি সমুদ্র বন্দরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টনেরও বেশি আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহন হয় সমুদ্রপথে। এসব পণ্যের খুব সামান্য অংশই দেশীয় পতাকাবাহী জাহাজে পরিবহন করা হয়। সূত্রটি জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে শুধু সমুদ্রপথে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে বাংলাদেশের ২ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশের মুদ্রায় ২৪ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রপ্তানি পণ্যভর্তি ৩০ লাখ ৯৭ হাজার ২৩৬ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছিল।

চারদিন পর মোংলা বন্দরে নোঙ্গর করলো সেই দুই বিদেশি জাহাজ

জানা যায়, বর্তমানে দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামের কেএসআরএম গ্রুপের হাতে দেশের বেসরকারি সেক্টরের জাহাজসমূহের এক তৃতীয়াংশের মালিকানা রয়েছে। এই সংস্থার হাতে রয়েছে ২৩টি জাহাজ। আকিজ গ্রুপের হাতে রয়েছে ১০টি জাহাজ, মেঘনা গ্রুপের রয়েছে ১১ থেকে ১২টি জাহাজ। কর্ণফুলী লিমিটেড গত দুবছরে ফিডার সার্ভিসের জন্য সংগ্রহ করেছে ছয়টি কনটেইনারবাহী জাহাজ। বসুন্ধরা গ্রুপের হাতে রয়েছে তিনটি জাহাজ, এগুলোর মধ্যে দুটি এলপিজি পরিবহনে ব্যবহার করা হয়। আরএজেএল বাংলাদেশের হাতে রয়েছে তেল পরিবহনকারী দুইটি জাহাজ, এমআই সিমেন্টর হাতে রয়েছে তিনটি জাহাজ। ক্রাউন শিপিংয়েরও নিজস্ব জাহাজ রয়েছে বলে নৌবাণিজ্য কার্যালয় জানিয়েছে। পাশাপাশি সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের রয়েছে নতুন ছয়টি এবং পুরনো দুটি মিলিয়ে মোট আটটি জাহাজ।

ইত্তেফাক/আরকে