শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘‌গুলি লাগার পরও কষ্ট মনে হয়নি, দেশের জন্য রক্ত দেওয়াটাই গর্বের’

আপডেট : ২৫ মার্চ ২০১৯, ১৭:০৭

ঘটনাটি ১৯৭১ সালের। মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ। পাকিস্তান আর্মিতে ভাইকেল মেকানিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন আবদুস সাত্তার। পূর্ব পাকিস্তানে ছুটিতে এসেছিলেন তিনি। এসে জানতে পারেন স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই ডাকে তিনি সাড়া দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। দেশকে স্বাধীন করেন নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে। বলছি- জাতীয় পদকপ্রাপ্ত যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তারের কথা। 

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরু থেকেই দেশে আসার জন্য মন কাঁদছিল তার। তৃতীয় সপ্তাহে ছুটি নিয়ে চলে আসেন দেশে। ছুটিতে এসে জানতে পারেন বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কথা। সেই ভাষণ শুনে দেশের স্বাধীনতার জন্য অংশগ্রহণ করেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। শুধু একটাই লক্ষ্য ছিল। যে কোনো মূল্যে, প্রয়োজনে নিজের রক্ত দিয়ে হলেও দেশ স্বাধীন করবেন। এমন প্রত্যয় নিয়েই নেমে পড়েন যুদ্ধের ময়দানে।

যুদ্ধ করেন ২ নম্বর সেক্টরে। যেখানে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। তিন থানার ইউনিট কমান্ডার হিসেবে ছিলেন আর্মি অফিসার গিয়াসউদ্দিন। তার অধীনেই টানা নয় মাস যুদ্ধ করেছেন আবদুস সাত্তার। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার ৭ দিন আগে পাক হানাদারের বন্ধুকের গুলি গুরুতর আহত হন সাহসী এই যোদ্ধা। গুলিটি তার বাম হাতের পেশী ভেদ করে বেড়িয়ে যায়। গুরুতর আহত হয়ে দাউদকান্দি থানার রামপুরা বাজারে এক গ্রাম্য চিকিৎসক বজলুর রহমানের কাছে চিকিৎসা নেন তিনি। সেখানে দুই দিন থেকে চলে যান ভবেরচরে। 

গুলিতে আহত হওয়ার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার বলেন, ‌‘৯ ডিসেম্বর ভবেরচর ব্রিজের উত্তর পাশে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমাদের মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। গোলাগুলির এক পর্যায়ে পাক হানাদারের বন্ধুকের একটি গুলি আমার বাম হাতে বিদ্ধ হয় এবং এটি পেশী ভেদ করে বেড়িয়ে যায়। তখন আমার হাত থেকে অনেক রক্ত ঝরছিল। কিন্তু একটিবারের জন্য শারীরিকভাবে কষ্ট লাগেনি। বরং নিজেকে গর্বিত মনে হচ্ছিল যে, দেশের জন্য আমি রক্ত দিতে পেরেছি।’ 

এসময় কিছুটা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন এই বীর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বলেন, ‘শুধু তাই নয়, মাতৃভূমির জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলাম আমি।’

এদিকে, তার পরিবারের কাছে খবর পৌঁছে যায় গুলি লেগে মারা গেছেন আবদুস সাত্তার। দুই দিন পর চলে আসেন ভবেরচরে। এরপর পরিবারের কাছে খবর পাঠান বেঁচে আছেন তিনি। ১৬ ডিসেম্বর ভবেরচরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জানতে পারেন যে, দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর শুনে আনন্দে ভিজে যায় তার দুই চোখ। হাতে ব্যান্ডেস নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন তিনি। সবার সঙ্গে মেতে উঠেন স্বাধীনতার আনন্দে। 

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জাতীয় পদক পান তিনি। তার জাতীয় পদকপ্রাপ্ত নম্বর-৬৬। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে মুক্তিবার্তায়ও।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত সনদ ও সেই সময়ে পাঁচশত টাকার অনুদান পান যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা জাতীয় পদকপ্রাপ্ত আবদুস সাত্তার। এটি তার জীবনের অন্যতম বড় প্রাপ্তি বলে মনে করেন তিনি। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে সেই সময়ে মুন্সীগঞ্জ জেলার এসডিওর মাধ্যমে সনদ ও পাঁচশত টাকার চেক পান। এখন নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন তিনি। 

এর আগে ১৯৭৩ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সেচ্ছায় অবসর নেন আবদুস সাত্তার। যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়ে বাম হাত হারানোর ফলে শারীরিকভাবে তেমন কোনো কঠিন কাজ করতে পারেন না তিনি। তাই আর্থিক স্বচ্ছলতার দেখা মেলেনি তার জীবনে। 

তার বাড়ি মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের জামালপুল গ্রামে। বর্তমানে তিন ছেলে সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বসবাস করেন তিনি। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাক প্রিয় বাংলাদেশ’- ৭৫ বছর বয়সী যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তারের এটাই প্রত্যাশা। 

ইত্তেফাক/কেকে