শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কঠোর সাজার পরেও বেপরোয়া পরিবহন শ্রমিকরা

আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০১৯, ০১:০৭

পরিবহন শ্রমিকদের নৃশংসতা থামছে না। এরা চলন্ত গাড়ি থেকে কোনো যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছেন, আবার কাউকে জখম করে ফেলছেন নদীতে। বাসে কোনো নারী যাত্রীকে একা পেয়ে ধর্ষণ শেষে হত্যা করে লাশ ফেলে দিচ্ছেন গভীর বনে। এসব ঘটনায় জড়িত বাসের চালক ও সহকারীকে দ্রুত আইনের আওতায় আনছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। দ্রুত বিচারের আওতায় আনায় অনেক মামলায় হচ্ছে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড; কিন্তু এরপরেও হুঁশ ফিরছে না। একের পর এক গুরুতর অপরাধ সংঘটন করেই চলেছেন পরিবহন শ্রমিকরা।

এদের নৃশংসতায় আঁতকে উঠছে দেশের মানুষ। এমনকি পাবলিক বাসে একা থাকলে এক অজানা আতঙ্ক ভর করছে নারী যাত্রীদের মনে। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে চট্টগ্রামে। ১১ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে একা বাসে পেয়ে যৌন হয়রানির চেষ্টা করে ওই বাসের সহকারী। মোবাইল ফোন দিয়ে বাসের হেল্পারের মাথায় আঘাত করে বাস থেকে লাফিয়ে পড়ে রক্ষা পান ওই ছাত্রী। এ ঘটনায় বাসের চালককে গ্রেফতার করে রিমান্ডেও নিয়েছে পুলিশ। সাধারণ যাত্রীরা মনে করছেন, দেশের গণপরিবহন এখন আর জনগণের পরিবহন নেই। সেবার পরিবর্তে এরা জনগণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।

বারবার কেন এমন ঘটনা ঘটছে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আজিজুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, এজন্য পরিবহন সেক্টরের অরাজকতার পাশাপাশি সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিও দায়ী। অপরাধ করলেই পার পাওয়া যাবে— এমন মানসিকতা থেকেই কেউ কেউ অপরাধ করে থাকে। তিনি বলেন, পরিবহন শ্রমিকরা নিরক্ষর ও দরিদ্র। এরা সুযোগ পেলেই নারীকে হয়রানি করতে চায়। নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়। এই পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে সকল সেক্টরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

২০১৭ সালের আগস্ট মাসে চলন্ত বাসে একা পেয়ে ধর্ষণ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বহুজাতিক কোম্পানির কর্মী রূপা খাতুনকে। এ ঘটনায় করা মামলায় ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাসের চালক ও চালকের তিন সহকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় টাঙ্গাইলের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগ গঠনের পর মাত্র ১৪ কার্যদিবসে সাক্ষ্য গ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষে এ মামলার বিচার শেষ করে আদালত। বর্তমানে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে।

এ ঘটনার রেশ না কাটতেই গত বছরের জুলাই মাসে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর শিক্ষার্থী সাইদুর রহমান পায়েলকে বাস থেকে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়। পায়েল চট্টগ্রাম থেকে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে ঢাকায় আসছিলেন। এ ঘটনায় বাসের চালক ও দুই সহকারী ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। চট্টগ্রামের বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল চলতি মাসে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। এখন মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। পায়েলকে হত্যার পরই চলতি বছরের ২২ মার্চ সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ঘোরি মো. ওয়াসিফ আফনানকে চলন্ত বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। পরে বাসটি তার শরীরের উপর দিয়ে চালিয়ে দিলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। গ্রেফতার হয় চালক ও সহকারীরা। ওই সময় সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এটা দুর্ঘটনা নয়, পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড। একই মত দেন বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় করা মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে। সর্বশেষ ৮ এপ্রিল রাতে সাভারের ধামরাইয়ে এক পোশাক শ্রমিককে চলন্ত বাসে ধর্ষণ করে চালক ও এর সহকারীরা। এ ঘটনায় জড়িতদের পরদিনই গ্রেফতার করে পুলিশ।

আরও পড়ুনঃ মানিকগঞ্জের সিংগাইরে ৩টি সড়কে খানাখন্দ, দুর্ভোগ চরমে

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, পরিবহন শ্রমিকদের এ ধরনের অপরাধ সংঘটনের মানসিকতা আগেও ছিলো, তবে সংখ্যায় কম। এখন সেটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ই মূল কারণ। নৈতিক অবক্ষয় যখন দেখা দেয় তখন সমাজের সর্বস্তরেই এর প্রভাব পড়ে। পরিবহন সেক্টরও এর বাইরে নয়। তবে শ্রমিকদের এই অপরাধ প্রবণতা রোধ করতে আমরা কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের রূপাকে ধর্ষণ ও হত্যার পর যারা জড়িত ছিলো তাদেরকে গ্রেফতারে আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করেছি। এর পরেও যেসব ঘটনা ঘটেছে জড়িত শ্রমিকদের কাউকে ছাড় দেইনি।