শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অবহেলায় ফজলির স্বত্ব হাতছাড়া!

আপডেট : ২৬ জুন ২০১৯, ০১:১৫

রাজশাহীর সুস্বাদু ফজলি আম পছন্দ করেন না এমন ভোজনরসিক বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর সেই ফজলিকেই নিজেদের দাবি করে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসাবে এর স্বত্ব নিয়ে গেছে ভারত! নাম দিয়েছে ‘মালদাহর ফজলি’। অথচ ঐহিত্যগতভাবেই ফজলি বাংলাদেশের। ইতিহাস বলে, বাংলাদেশ থেকেই এক সময় কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে ফজলি যেত। সেই ফজলির স্বত্ব হারানোর পরও বাংলাদেশ চুপচাপ। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। তবে আশার কথা গবেষকরা বলেছেন, এখনো সুযোগ আছে। বাংলাদেশ ‘রাজশাহীর ফজলি’ নামে নিবন্ধন নিতে পারে।

এ প্রসঙ্গে রাজশাহী ফল গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিমুদ্দিন গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ভারত ‘মালদাহর ফজলি’ হিসেবে নিবন্ধন নিলেও কোনো সমস্যা নেই। আমরা ‘রাজশাহীর ফজলি’ হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছি। তিনি বলেন, রাজশাহীর বাঘা, চারঘাট এলাকায় দুইশ বছরের আগে থেকে ফজলি আম চাষ হয়ে আসছে। তখন কলকাতার বাজারে এখান থেকে এই আম পাঠানো হতো। বিশিষ্ট আম গবেষক মাহবুব সিদ্দিকীর ‘আম’ বইয়েও এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

জানা গেছে, দেরিতে হলেও রাজশাহী ফল গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পেতে পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরে আবেদন করেছে। অথচ ভারত ২০০৮ সালেই বাংলাদেশের ফজলিকে ‘মালদাহর ফজলি’ নামে নিবন্ধনের কাজটি সেরে নিয়েছে।

ফজলি আমের তথ্য খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, ডব্লিউ এইচ নেলসনের ‘ফাইনাল রিপোর্ট অন দ্য সার্ভে এন্ড সেটেলমেন্ট ইন দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব রাজশাহী ১৯১২-১৯২২’ বইয়েও বাঘার ফজলি আমের কথা তুলে ধরা হয়েছে। বইতে বলা হয়েছে, এই আম অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় কলকাতাতে এখান থেকেই এই আম যেত।

ড. আলিমুদ্দিন আরো বলেন, ফজলি আম রাজশাহীর ঐতিহ্য, ইতিহাসের অংশ। এই সম্পদ আমাদের রক্ষা করতে হবে। তাহলে এতদিনেও আপনারা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেননি কেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফজলি যে আমাদের আম, সে ব্যাপারে সকল তথ্য-প্রমাণ আমরা যোগাড় করে এক বছর আগে পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরে পাঠিয়েছি।

প্রসঙ্গত, ট্রিপস (ট্রেড রিলেটেড আসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস) চুক্তির ২৭.৩ (খ) ধারায় পৃথিবীর সব প্রাণ-প্রকৃতি-প্রক্রিয়ার ওপর পেটেন্ট করার বৈধ অধিকার রাখা হয়েছে। কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উত্পাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে একই পণ্য অন্য একাধিক দেশ উত্পাদন করলে যে দেশ পণ্যটি সবচেয়ে বেশি উত্পাদন করবে এবং পণ্যটি যে দেশে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হবে, সে দেশই ওই পণ্যের স্বত্ব পেতে অগ্রাধিকার পাবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশেই বেশি পরিমাণে ফজলি আমের চাষ হয়। ফজলির মূল উত্পাদনস্থল রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের ফজলি আমই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও অত্যন্ত সুস্বাদু। সীমিত হারে রপ্তানিও হচ্ছে কোনো কোনো দেশে।

ড. আলিমুদ্দিন বলেন, অত্যন্ত জোড়ালো তথ্য-প্রমাণ আমাদের রয়েছে। যে কৃষকরা বংশ-পরম্পরায় ফজলি আমের চাষ করে আসছেন, তাদের তালিকা আমরা পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরে পাঠিয়েছি। এছাড়া সুনির্দিষ্টভাবে জাতের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। মানচিত্রের মধ্যে দেখিয়েছি কোথায় ফজলি আমের চাষ হয়। তিনি বলেন, এই আম লম্বায় ১৩ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার, পাশে ৯ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার, পুরুত্ব ৭ দশমিক ৮ সেন্টিমিটার হয়। প্রতিটি আমের গড় ওজন ৬৫৫ গ্রাম। পাকা আমের রং হয় সবুজাভ হলুদ, রসালো, সুগন্ধযুক্ত, সুস্বাদু ও মিষ্টি। পাকা আমের খোসা পাতলা, আঁটি লম্বা, চ্যাপটা ও পাতলা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা আমাদের ফজলির ‘আরডিএনএ’ সিকোয়েন্স করেছি। এটা যদি ভারতের ফজলির সঙ্গে না মেলে তাহলে আমরা আমাদের ফজলির জিআই পাব।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী কোনো পণ্যের ভৌগোলিক নির্দেশকের জন্য নিবন্ধন নিতে হয়। জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পেলে সংশ্লিষ্ট পণ্যের মালিক হবে সেই দেশ। তারা সেই পণ্যের ব্যবসায়িক মুনাফার সম্পূর্ণ অংশের মালিক হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এসব পণ্যের মালিকানা বা স্বত্ব আর কোনো দেশ দাবি করতে পারবে না। শুধু তাই নয়, দেশের মধ্যেও অন্য কোনো এলাকার জনগোষ্ঠী এ পণ্যের মালিকানা পাবে না।

ইত্তেফাক/আরকেজি