শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রোহিঙ্গা সমস্যার দুই বছর: সমাধান কোথায়?

আপডেট : ২০ আগস্ট ২০১৯, ২১:৩৯

রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যের একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। গত কয়েক দশক ধরে ক্রমবর্ধমান রাষ্ট্রীয় বৈষম্য, বঞ্চনা এবং নিপীড়নের শিকারে পরিণত হয়ে আসছে। দুই বছর আগে মায়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা পত্র-পত্রিকার শিরোনামে পরিণত হয়েছিল। তখন থেকে আজ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের এই অঞ্চলে আইনগত বৈধতার সংকট সমাধানে, অথবা তাদের মিয়ানমার ছেড়ে চলে আসার অন্তর্নিহিত কারণসমূহ খতিয়ে দেখার ক্ষেত্রে খুব কমই অগ্রগতি হয়েছে।

কক্সবাজারে কর্মরত এমএসএফ-এর ইমারেজেন্সি কোঅর্ডিনেটর আরুন জেগান বলেন, ‘আমি প্রথম কক্সবাজার এসেছিলাম ২০১৭ সালের জুন মাসে। তখনও আগের কয়েকটি সহিংস ঘটনার শিকার হয়ে পালিয়ে আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ছিল। এমন কি তখনো, মানবিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা ছিল ব্যাপক। আমি সেই বছরের আগস্ট মাসে ফিরে আসি প্রকল্প সমন্বয়ক (প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর) হিসেবে, যখন আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দুই সপ্তাহ ধরে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসছিলো। আমরা স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম সীমান্তের ওপারে ধোঁয়ার কুন্ডলি, খুব সম্ভবত সীমান্তবর্তী বেশ কিছু বাড়ি ও গ্রামে আগুন দেয়া হয়েছিল। আমরা দেখেছিলাম সীমান্ত পারাপারে আগুনে পোড়া, গুলিবিদ্ধ, গভীর কাটা ক্ষত এবং ধোঁয়াজনিত শ্বাসকষ্ট নিয়ে রোহিঙ্গারা আসছে। সেই আতঙ্ক তাদের চেহারা ও শরীরে দৃশ্যমান ছিল”। 

রোহিঙ্গারা যেসব দেশে পালাতে বাধ্য হয়েছে, সবখানেই তাদের মূলত সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এবং আজ পর্যন্ত তাদের কোনো অর্থপূর্ণ সমাধান দেয়া হয়নি। বাংলাদেশে যখন তারা এসেছিল, ঠিক সেই সময়ের মতো ৯,১২,০০০-এর বেশি রোহিঙ্গা আজও সেই বাঁশ আর প্লাস্টিক দিয়ে বানানো ঘরে থাকে; চলাচল ও কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতার মধ্যে এবং সম্পূর্ণরূপে মানবিক সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে তারা জীবনযাপন করছে। শিশুরা স্কুলে যেতে না পারায় পরবর্তী প্রজন্ম তাদের অবস্থার উন্নতি সাধনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গত দুই বছরে এমএসএফ রোহিঙ্গাদের যেসব রোগের চিকিৎসা দিয়েছে তার বেশির ভাগই স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা এবং পানীয় জলের অভাব তথা তাদের মানবেতর পরিবেশে বসবাসের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। এমএসএফ ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ১৩ লাখেরও বেশি চিকিৎসা পরামর্শ (মেডিক্যাল কনসালটেশন) দিয়েছে এবং প্রতি মাসে হাজার হাজার রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে আসছে। 

আরুন জেগান বলেন, ‘দুই বছর পার হয়ে গেল, এখন ক্যাম্পের ভেতর ও বাইরে ভালো রাস্তা তৈরি হয়েছে, আরও বেশি স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও পরিষ্কার পানির উৎস বসানো হয়েছে। সবকিছু আগের চেয়ে গোছানো। কিন্তু ক্যাম্প এখনও অনিরাপদ এবং রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী হবে– এরকম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি’।

মায়ানমারে যেসব রোহিঙ্গা এখনো রয়ে গেছে তাদের অবস্থাও একই রকম নিদারুণ। ১৯৮২ সালে এক নাগরিকত্ব আইন দিয়ে তাদের কার্যত রাষ্ট্রহীন করে দেওয়া হয়েছে, এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের আরো অনেক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে; এর মধ্যে রয়েছে নাগরিক সুবিধার অন্তর্ভুক্তি, শিক্ষার অধিকার, বিয়ে, পরিবার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে চলাচলের স্বাধীনতা এবং স্বাস্থ্যসেবা।

২০১২ সালে রোহিঙ্গা ও রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যকার সহিংসতায় অনেক গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে মধ্য রাখাইনের প্রায় ১,২৮,০০০ রোহিঙ্গা ও কামান মুসলিমরা ঘনবসতিপূর্ণ ও নোংরা উদ্বাস্তু শিবিরে বাস করছে। চলাচল ও কর্মসংস্থানের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়ে, এবং একই সঙ্গে মৌলিক অধিকার না পেয়ে তারা মূলত পুরোপুরি মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভর করছে। 

রাখাইন রাজ্যজুড়ে এখন আনুমানিক প্রায় সাড়ে ৫ লাখ থেকে ৬ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। তাদের বর্তমানের জীবন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে, কারণ মায়ানমারের সেনাবাহিনী ও রাখাইনের আরাকান জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র বাহিনী আরাকান আর্মির মধ্যকার চলমান সংঘাত আরও খারাপ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে এবং এর প্রভাবে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সম্প্রদায়কে ভুগতে হচ্ছে।

আরুন জেগান বলেন, ‘যখন আমি রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি, আমি সবচেয়ে বেশি চাই যেন তারা নিরাপদে নিজেদের বাড়ি ফিরতে পারে। ততদিন পর্যন্ত, আমি আশা করি, তারা ব্যাপকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকবে, শিক্ষার অধিকার ও আশানুরূপ বৈধ স্বীকৃতি পাবে। যদি এই কাজগুলো এখন করা না হয়, আমার আশঙ্কা - রোহিঙ্গা জনগণ আগামী দুই বছরও একই অবস্থায় থাকবে, তখন হয়তো আরও কম সেবা তারা পাবে। মানবিক সহায়তার হার যেকোনো পরিমাণে কমানো হলে তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বাবলম্বী হওয়ার পথ উন্মুক্ত করতে হবে’।

ইত্তেফাক/বিএএ