শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দেবিদ্বারে সমাহিত অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ

আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০১৯, ২১:২৮

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, দেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের পথিকৃৎ ও ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছে। রবিবার বাদ যোহর দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদে চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের কার্যালয়ের মাঠে চতুর্থ জানাজা শেষে তার দাফন সম্পন্ন করা হয়। 

এর আগে শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দেশবাসীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হন দেশবরেণ্য প্রয়াত রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। শনিবার দুপুরে শেষ শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ। এর আগে কুঁড়েঘর প্রতীক খ্যাত মোজাফফর আহমদের প্রথম জানাজা জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হয়। 

জানাজা শেষে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মোজাফফর আহমদকে গার্ড অব অনার ও রাষ্ট্রীয় সালাম প্রদান করা হয়। এ সময় এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। জানাজা শেষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পক্ষে তার সহকারী সামরিক সচিব, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী মৃতদেহে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। 

পরে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা শ্রদ্ধা জানান। দুপুরে শহীদ মিনারে নেওয়ার আগে ধানমন্ডিতে পার্টি অফিসের সামনে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শনিবার বাদ আসর বায়তুল মোকাররম মসজিদে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তার মৃতদেহ কুমিল্লার দেবিদ্বারের এলাহাবাদে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। 

রবিবার সকাল ১০টায় কুমিল্লা টাউন হল মাঠে মোজাফফর আহমদের তৃতীয় জানাজা এবং মরহুমের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কুমিল্লাবাসী। সর্বশেষ মরহুমের গ্রামের বাড়ি জেলার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদে চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের কার্যালয়ের মাঠে চতুর্থ জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়। 

আরও পড়ুন: প্রধান ৫ দাবি না মানলে ফেরত যাবে না রোহিঙ্গারা

জানাজা শেষে মোজাফফর আহমদকে গার্ড অব অনার ও রাষ্ট্রীয় সালাম প্রধান করেন কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর, পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম ও দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবীন্দ্র চাকমা। 

উল্লেখ্য, গত শুক্রবার (২৩ আগস্ট) সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর।


ফিরে দেখা:

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামের সম্ভ্রান্ত ভূঁইয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা স্কুল শিক্ষক কেয়াম উদ্দিন ভূইয়া, মা আফজারুন্নেছা।

তিনি দেবিদ্বার উপজেলার হোসেনতলা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণী, দেবিদ্বার রেয়াজউদ্দিন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৩৯ সালে মেট্টিক ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আইএ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং ইউনেস্কোর ডিপ্লোমা লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা ছাড়াও বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেন।

চল্লিশের দশকে যারা ছাত্রাবস্থায় বামপন্থায় দীক্ষা নিয়েছিলেন, মোজাফফর আহমদ তাঁদের একজন। হয়ে পড়েন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মোজাফফর আহমদের একনিষ্ঠ অনুসারী। ১৯৫২র ভাষা আন্দোলন কালে তাঁর আজিমপুর কলোনির ৮/আই, নাম্বারের বাসায় নিয়মিত বৈঠক করতেন তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ, যাঁদের মধ্যে নেপাল নাগ, খোকা রায়, অনিল মুখার্জি, সত্যেন সেন অন্যতম। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।

কুঁড়েঘর প্রতীক খ্যাত অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯-এ আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের কাড়নে গ্রেফতার হন। ১৯৭১‘র স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান নেতৃত্বের অন্যতম ব্যক্তি হিসেবে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। ওই সময় তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন।

স্বাধীনতার পর তিনি ১৯৭৯ সালে এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে ন্যাপ, সিপিবি এবং প্রগতিশীল শক্তির প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, অস্ট্রিয়া, ভারত, লিবিয়া, আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যসহ পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের বহু দেশ সফর করেন।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী বয়োজোষ্ঠ্য বাম নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বার্ধক্যের কারণে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেকটাই অবসরে ছিলেন। বার্ধক্য জনিত নানা শারীরিক সমস্যা বাসা বেধে ছিল তার দেহে। অনেকটাই চলৎশক্তি হীন অবস্থায় বারিধারার পার্ক রোডের মেয়ের বাড়িতে স্ত্রী ও কন্যার পরিচর্চায় ছিলেন তিনি।

ইত্তেফাক/অনি