শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

আজ পয়লা কার্তিক, হেমন্ত এলো ধূসর বিবর্ণে

আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০১৯, ১৩:০৬

টলটলে মুক্তো বিন্দুর মতো শিশির জমতে শুরু করেছে ঘাসের ডগায়;ধানের শীষের প’রে। আদিগন্ত মাঠ জুড়ে এখন ধানের প্রাচুর্য, সবুজ স্বপ্ন দুলছে।হলুদে-সবুজে একাকার নয়নাভিরাম অপরূপ প্রকৃতি। চারদিকে ধূসর আবহ ঘিরে রাখছে। হিম হিম, স্বল্পায়ু দিন ক্রমে মিইয়ে যাচ্ছে, শেষ বিকালে কুয়াশার আবছা চাদর প্রকৃতিকে ঢেকে শিশিরের শব্দের মতো নামছে সন্ধ্যা। ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর/ হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন পাথারের ওপার থেকে/ আনল ডেকে হেমন্তকে...আজ পয়লা কার্তিক। আবহমান বাংলায় ষড় ঋতুর পরিক্রমায় এলো হেমন্ত।

শরতের পর কার্তিক-অগ্রহায়ণ মিলে হেমন্ত। নতুন ঋতুর আগমনে রূপ বদলায় প্রকৃতি। প্রকৃতির ম্লান, ধূসর ও অস্পষ্টতার অনুভূতি হানা দেয় চেতনলোকে।হেমন্তকে বলা হয় শীতের বাহন। প্রকৃতিতে অনুভূত হচ্ছে শীতের আমেজ। গ্রামীণ জনপদে এখন হালকা শীতের আমেজ। আকাশ থেকে খণ্ড খণ্ড মেঘ সরে গিয়ে উদোম হয়েছে বিশাল নীল আকাশ।কবি শ্রীযুক্ত রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের ভাষায়— ‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা-/ হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা।/ সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে,/ কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা।/ ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।/ দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে...। হেমন্তের কবি জীবনানন্দ দাশ ‘বনলতা সেন ’কবিতায় হেমন্তের চিত্র এঁকেছেন।‘ সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা নামে/ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল/ পৃথিবীর সব রং মুছে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন / তখন গল্পের তরে জোনাকির রং ঝিলিমিল/ সব পাখি ঘরে আসে সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেন দেন/ থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’।

গতকাল সন্ধ্যায় অস্ত যাওয়া আশ্বিনের শেষ সূর্যটার সাথে নগরের তপ্ত শ্বাসও অস্ত যাওয়ার কথা, কিন্তু জলবায়ুর যে নিত্য বদল, তাতে এ আবহাওয়া আরো কিছু দিন থাকবে। অগ্রহায়ণে ধান কাটার সাথে সাথে দশ প্রহরণ মেলতে শুরু করবে শীত। হেমন্তকে সবচেয়ে চেনা যায় ভোরের শিশিরে। খুব ভোরে একটি শীতল বাতাসে। সবুজ পাতার গায়ে জমে থাকা শিশির বিন্দু অপার্থিব দৃশ্যমালা রচনা করে। জীবনানন্দ দাশের ভাষায়- লিপি কাছে রেখে ধূসর দ্বীপের কাছে আমি/নিস্তব্ধ ছিলাম ব’সে;/শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;/নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি/উড়ে গেলো কুয়াশায়,-কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরো...।

 হেমন্ত জীবন ও প্রকৃতিতে এক আশ্চর্য সময় হয়ে ওঠে। বর্ষার পরে এই সময়ে বৃক্ষ রাজি থাকে সবুজে ভরা। ভরা থাকে খাল-বিল নদী-নালা। বিল জুড়ে সাদা-লাল শাপলা আর পদ্ম ফুলের সমারোহ। এই হেমন্তের দুই রূপ প্রতিভাত হয়। প্রথম মাসটির এক রূপ। পরেরটির অন্য। এক সময় হেমন্তের প্রথম মাসটি ছিল অনটনের। ফসল হতো না। বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিত। সারা বছরের জন্য জমিয়ে রাখা চাল ফুরিয়ে যেত এ সময়ে এসে। ধানের গোলা শূন্য হয়ে যেত। কার্তিকের দুর্নাম করে তাই বলা হতো ‘মরা কার্তিক’। কবি গুরুর কবিতায়ও আভাস পাওয়া যায় মন্দ্রাক্রান্ত কার্তিকের। কবিগুরু লিখেছেন- ‘শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান,/কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে।’ধূসর বিবর্ণে ভরা ঋতু হেমন্ত। এই ঋতু সুফলা নয়। মৌসুমী কোন শস্য বা আনাজ আমরা এই ঋতুতে পাইনা। বর্ষা ও শরতের কখনো অনাবৃষ্টি আবার কখনো অতিবৃষ্টির কারণে এই ঋতু বরাবরই নিষ্ফলা থাকে। শাক সবজি ফলমূলেরও আকাল। দাম তাই আকাশচুম্বি। কবির কথায় ‘পুলকে আর বিষাদে ভরা থাকে এই ঋতু।

খালবিল থেকে সবে মাত্র বর্ষার জল শুকাতে শুরু করে। আকাশে মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়ায় নীল মেঘের ভেলা। কাঁশবনের শন শন শব্দ আর পাখ পাখালির কিচির মিচিরে জনপদ মুখর থাকে ।পরাণে তীব্র শীস দেয়  কোন এক আকুলতা। গ্রামাঞ্চলে শুরু হয় মাছ ধরার উৎসব। বর্ষা আর শরতের বৃস্টির জলধারা হেমন্তে শুকাতে থাকে। মাছ ভাতে বাঙালি হেমন্তকালে জাল, বর্শা, পলো, লুই নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গ্রামের গেরস্থ কর্তা ঘরে ফেরে ডুলাভর্তি মাছ নিয়ে।

চোখ আটকে যায় শুকনো জলাশয়ে ঝিমানো কচুরিপানার বেগুনি-শাদা ফুলকলিতে। ফসলহীন খেতের আলপথে জংলি ফুল পাখা মেলে। পথে পথে সবুজ বুনোলতায় পতঙ্গের খুনসুটি। একটি-দুটি ফুলও ঝরে পড়ে ঘাসের নরম কার্পেটে। কাঁঠালিচাঁপার গন্ধ ডাকে দুপুরের সঙ্গী হতে। মনে হয়, কোনো নবীনা কনেবউয়ের মুখের উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। লাজুক রঙের বাহার। পথের বাঁকে হালকা বাতাসে ওড়ে হেমন্তের ধুলো, ধানের পরশ মাখা। ঘুঘুডাকা নিঝুম বিকেল, কানে ফুলের ঝুমকো বসিয়ে গালফোলা চঞ্চল কিশোরী গাছে হেলান দিয়ে শোনে বিকেলপাখির কিচিরমিচির। আবহমান বাংলা ছাড়া কোথাও মেলে না ।হেমন্তের এই রূপ প্রত্যক্ষ করে আমাদের জাতীয় কাজী নজরুল ইসলামের অমর উচ্ছ্বাসকাব্য—‘এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী’, ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবনি।’

কার্তিকের পর অগ্রহায়ণে আবার উল্টো চিত্র। নবান্নের এই মাস সমৃদ্ধির। এ সময় মাঠের সোনালি ফসল কাটা শুরু হয়। দেখতে দেখতে গোলা ভরে ওঠে কৃষকের। হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানে ভরে ওঠে। কৃষক বধূ ধান শুকোতে ব্যস্ত। প্রতি ঘর থেকে আসে ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ। দিনে দিনে বদলাচ্ছে সেই হিসাব-নিকাশ। এখন আগের সে অভাব নেই। শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। আয় রোজগারও বেশ। পাশাপাশি এখন কার্তিক মাসেই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ। পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। অগ্রহায়ণ পুরোটাজুড়ে সারা বাংলায় চলবে নবান্ন উৎসব। বাঙালির উৎসব বলতেও হেমন্ত; যার নেপথ্যে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলার হাজার বছরের কৃষিসংস্কৃতি।বাঙালির প্রধান ও প্রাচীনতম উৎসবগুলোর অন্যতম নবান্ন। 

আবহাওয়াবিদদের মতে, এখন থেকে যত দিন যাবে ততই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কমতে থাকবে। পার্থক্য যত কমবে তত শীত আসতে থাকবে। উত্তরের হিম হিম বাতাসে শুষ্ক হয়ে আসবে শরীর।তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এখন প্রকৃতি যেন আর নিয়ম মানছে না। কেমন খামখেয়ালী হয়ে উঠেছে।