শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথের বাড়ি

আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:৪৩

ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথের স্মৃতিচিহ্ন আধাপাকা টিনশেড বাড়িটি অযত্ন-অবহেলায়-অনাদরে পড়ে আছে। ১৯৭১ সালে কুমিল্লা নগরীর ধর্মসাগরের পশ্চিমপাড়ের নিজ বাড়ি থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে সেনানিবাসে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর থেকে এ বাড়ির অবকাঠামো ক্রমেই ভেঙে পড়তে থাকে। এই বাড়ি দেখে এখন আর বোঝার উপায় নেই, এখানে একসময় অবিভক্ত পাকিস্তানের এক জন প্রথিতযশা বর্ষীয়ান রাজনীতিক বসবাস করতেন। ২০১০ সালে তত্কালীন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বাড়িটি পরিদর্শন করতে এসে এখানে ‘ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি জাদুঘর’ নির্মাণের আশ্বাস দিলেও গত প্রায় ১০ বছরেও এর বাস্তবায়ন হয়নি।

ধীরেন্দ্রনাথের শিক্ষা-কর্ম ও রাজনীতিক জীবন

শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর তত্কালীন ত্রিপুরা, বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের রামরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ধীরেন্দ্রনাথ ১৯০৪ সালে নবীনগর হাইস্কুল হতে প্রবেশিকা, ১৯০৬ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এফএ, ১৯০৮ সালে কলকাতা রিপন কলেজ (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) হতে বিএ এবং ১৯১০ সালে একই কলেজ হতে বিএল পরীক্ষায় পাশ করেন।

১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস থেকে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য এবং একই বছরের শেষ দিকে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য পূর্ববঙ্গ থেকে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালের জুন মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন প্রবর্তনের বিরুদ্ধে একটি ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর হতে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন।

ভাষা আন্দোলনে ভূমিকার জন্য টার্গেট ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ঐ অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-ই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে সোচ্চার হন। তিনি অধিবেশনে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, গণপরিষদে যে কার্যবিবরণী লেখা হয় তা ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লিপিবদ্ধ হয়। সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। অধিবেশনে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি তুলেন তিনি। তখনকার পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এতে ক্ষিপ্ত হন। এতে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান-সরকারের রোষানলে পড়ে কয়েক বার কারাবরণ করেন। ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখার জন্য আগে থেকেই টার্গেট হয়ে ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ। আর সে কারণে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রথম দিকেই ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ গভীর রাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কুমিল্লা শহরের ধর্মসাগরের পাড়ের এই বাড়ি থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তার ছেলে দিলীপ কুমার দত্তকে ধরে নিয়ে যায় কুমিল্লা সেনানিবাসে। সেখানে ৮৫ বছর বয়স্ক এই দেশপ্রেমিক রাজনীতিককে অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। সঙ্গে তার ছেলে দিলীপ কুমার দত্তও শহীদ হন সেদিন। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মৃতদেহ কেউ খুঁজে পায়নি।

পুরস্কার, সম্মাননা ও স্মারক

বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অসাধারণ অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করা হয়। কুমিল্লা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ তার নামে জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন সড়ক পর্যন্ত সড়কটি ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সড়ক’ নামকরণ করে। ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে তার নামে একটি ‘ই-লাইব্রেরি’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০৬ সালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল’ নামে ছাত্রদের জন্য একটি আবাসিক হল করা হয়। এছাড়া কুমিল্লা স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে ‘ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম’।

কুমিল্লা নাগরিক ফোরামের সভাপতি মো. কামরুল আহসান বাবুল বলেন, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মাতৃভাষা দিবসের রূপকার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম উভয়েই কুমিল্লার সূর্যসন্তান। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটি ‘ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি জাদুঘর’ ও রফিকুল ইসলামের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য আরো কিছু স্থাপনায় তাদের নাম সংযোজন করতে সরকারের কাছে দাবি জানান।

মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর সরকারের পূর্বাঞ্চলে ইয়ুথ ট্রেনিং কন্ট্রোল বোর্ডের পরিচালক ও প্রশিক্ষণ সমন্বয়কারী অধ্যাপক দেবব্রত দত্ত গুপ্ত বলেন, একাত্তরে যুদ্ধ শুরু হলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তার ছেলেকে এই বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সেনানিবাসে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

ইত্তেফাক/কেকে