শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ফিরে দেখা

১৪৪ ধারা ভাঙার গল্প

আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৯:৫৩

ইত্তেফাকের প্রথম চিফ রিপোর্টার শিশুসাহিত্যিক ফয়েজ আহ্মদ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সারা ঢাকা শহর চষে বেড়িয়েছেন। ঐদিনের ঘটনা তিনি তাঁর নানা স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ৯৯ নম্বর নবাবপুরের আওয়ামী লীগের অফিসে ভাষাসংক্রান্ত কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয় ২১ তারিখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে না। তখন যুবলীগ ও অন্য কয়েকটি সংগঠনের সদস্যরা উপস্থিত হতে পারেননি। তাঁরা যখন জানতে পারেন যে, আগামীকাল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হচ্ছে না, তখন এর বিরোধিতা করেন। অলি আহাদ, এমাদুল্লাহ প্রমুখের প্রবল চাপে গৃহীত প্রস্তাবে যোগ করা হয়—‘কিন্তু যদি ছাত্ররা চান, তবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত বাতিল বলে গণ্য হবে’।

সেই রাতেই ১১টার পর ফজলুল হক হল ও ঢাকা হলের মধ্যবর্তী পুকুর পাড়ে ছাত্রনেতাদের গোপন বৈঠক হয়। এই বৈঠকে ছিলেন কবি হাসান হাফিজুর রহমানও। সিদ্ধান্ত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি অবশ্যই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। এর আগে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হবে আমতলায়। এই বিক্ষোভ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক। বক্তব্য রাখেন শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, কাজী গোলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ ও আবদুল মতিন। সভাপতি ১০ জন করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের নির্দেশ দেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোহার গেট খুলে ছাত্রছাত্রীরা এক এক করে বের হতে শুরু করেন। প্রথম দলের অগ্রভাগে ছিলেন আলী আজমল ও মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। দ্বিতীয় দলের নেতৃত্ব দেন ইব্রাহিম তাহা ও আবদুস সামাদ। তৃতীয় দলের নেতৃত্বে ছিলেন আনোয়ারুল হক খান ও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পুলিশের লাঠিপেটা ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ। কয়েকজনকে পুলিশ-ভ্যানে উঠিয়ে পাঠানো হয় জেলে। কেউ কেউ পাশের পুকুরে লাফ দিয়ে আত্মরক্ষা করেন।

সে সময় এখনকার ডেন্টাল কলেজের আশেপাশে কনস্ট্রাকশন ফার্মের ইট-পাটকেল ছিল। জায়গাটি ছিল খোলা ছাত্রাবাসের সামনে। পুলিশের একটা ব্যাটালিয়ান সেখানে উপস্থিত হয়ে সামনের রাস্তা ঘেরাও করে দাঁড়ালে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। সরকারবিরোধী ও বাংলা ভাষার পক্ষে স্লোগান দিতে থাকেন তাঁরা। বিকেল ৩টার পর সেখানে ঢাকার অ্যাডিশনাল এসপি মাসুদ উপস্থিত হয়ে গুলির অর্ডার দিয়ে চলে যান। বিকেল চারটার সময় গেটের ভেতরে ঢুকে আকস্মিকভাবে গুলি করতে শুরু করে পুলিশ। ঘটনাস্থলে নিহত হন মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। আহত হন ২০ জন। এঁরা একজনও ছাত্রনেতা বা বিপ্লবী ছিলেন না। সন্ধ্যা ৭টায় প্রতিবাদী ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয়। এ সময় শহিদ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র বরকত। রাত আটটায় আহতদের মধ্যে মারা যান আবদুল জব্বার ও রফিকউদ্দিন আহমদ। শহরে রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মোতায়েন করা হয় সৈন্য। গ্রেফতার হন ৯১ জন।

পরদিন ঢাকা শহর হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। সকালে মেডিক্যাল কলেজের সামনে হাজার হাজার মানুষ শহিদদের গায়েবানা জানাজায় অংশগ্রহণ শেষে শোক মিছিল বের করে। মিছিলটি যখন কার্জন হলের সামনে দিয়ে আসছিল, তখন আবদুল গনি রোডের মুখে শতাধিক পুলিশ ও আর্মড গার্ড পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে। আবদুল গনি রোডের অর্ধেকটা যাওয়ার পর পুলিশ মিছিলটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এলোপাতাড়ি লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এখানে হাইকোর্টের এক কর্মকর্তা শফিকুর রহমান ঘটনাস্থলেই নিহত হন। মিছিলের পেছনের অংশ ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও সামনের অংশ এগুতে থাকে। সিদ্দিকবাজার হয়ে নবাবপুর, পাটুয়াটুলি, ইসলামপুর হয়ে অগ্রসর হতে থাকলে পুলিশ মোড়ে মোড়ে মিছিলের ওপর আক্রমণ করে। নিহত হন আবদুল আউয়ালসহ অজ্ঞাতনামা দশ বছরের এক বালক ও একজন যুবক। সন্ধ্যা ৬টা থেকে জারি করা হয় কারফিউ।

ইত্তেফাক/কেকে