শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

স্বাগত আমেরিকা, তোমাকে মিস করেছি

আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২০, ০৫:৫২

দুঃসহ দীর্ঘশ্বাসের লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি!

আমেরিকার নির্বাচনের দিন থেকে কী শ্বাসরুদ্ধকর চারটি দিন পার করলাম! তীক্ষ, তীব্র উত্তেজনায় পরিপূর্ণ ছিল এই চারটি দিন। টানটান স্নায়ুচাপের মধ্যে দমবন্ধ অবস্থায় যেন মনে হচ্ছিল এই অবস্থা ফুরাবে না কখনো, অনন্তকাল চলবে। অবশেষে এলো সেই অসম্ভব আনন্দের মুহূর্ত—কমলা হ্যারিস ও জো বাইডেন তাদের বিজয় বক্তৃতায় সেই আনন্দের অভিষেক ঘটালেন। সদ্য পরাজিত প্রেসিডেন্ট চার বছর ধরে যে জঘন্য বর্ণবাদ, মিথ্যাচার ও উন্মাদনা দেখিয়েছেন, তার বিপরীতে বাইডেন ও হ্যারিসের বিজয়-বক্তৃতার মূল সুর ছিল অনবদ্য। বাইডেন আমেরিকার এমন এক প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন, যিনি সত্যিকারের একজন নেতা ও রাষ্ট্রের মুখপাত্র। এজন্য তার বিজয় এনে দিয়েছে অসম্ভব স্বস্তিময় এক সুন্দর অনুভূতি। বাইডেন বলেছেন, তিনি এমন একজন প্রেসিডেন্ট হবেন, যিনি বিভাজনের রাজনীতি না করে বরং ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন। কোনটা লাল (রিপাবলিকান) এবং কোনটা নীল (ডেমোক্র্যাট) স্টেট, সেটা তিনি দেখবেন না। তিনি দেখবেন সেটাই, যেটাকে বলে ইউনাইটেড স্টেটস, অর্থাত্ ঐক্যবদ্ধ একটি দেশ—যুক্তরাষ্ট্র।

জাতির উদ্দেশে দেওয়া বাইডেনের ভাষণের মাধ্যমে সারা বিশ্ব যেন হূদয়ঙ্গম এটাই করতে পারল যে, আমেরিকা অবশেষে তার দুঃস্বপ্নের প্রহর কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। যদিও মনে হতে পারে, একজন শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন—এর মধ্যে নতুন কী আছে, যা আমরা আগে দেখিনি? কিন্তু এই বিজয়ের রাতটি প্রকৃত অর্থেই ঐতিহাসিক। কারণ বাইডেনের রানিংমেট, অর্থাত্ তার ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস অনেকগুলো নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। তিনি কেবল প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্টই নন, একই সঙ্গে তিনি প্রথম দক্ষিণ এশীয় এবং অশ্বেতাঙ্গ নারী।

এটা নিঃসন্দেহে অভিভূতকর একটি ঘটনা যে, কমলা হ্যারিসের মতো একজন অশ্বেতাঙ্গ নারী অবশেষে সেই চূড়ায় পৌঁছাতে পেরেছেন, হিলারি ক্লিনটনের পক্ষেও যেখানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে হিলারির অবদানও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি নারীদের জন্য তৈরি করা বদ্ধ সিলিংটিতে এমন ফাটল ধরাতে পেরেছিলেন, যা পুরোপুরি ভেঙে একজন অশ্বেতাঙ্গ (কমলা হ্যারিস) নারীকে আমেরিকার সর্বোচ্চ অফিসে প্রবেশের পথ তৈরিতে বিশেষ সহায়তা করেছে।

কমলা হ্যারিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়াটা এজন্য অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ যে, সারা বিশ্বের একটি ছোট্ট মেয়ের কাছেও এখন এই বার্তা পৌঁছে গেল—তারাও চাইলে এই চূড়ায় আসীন হতে পারবে। তারাও আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে পারবে, এমনকি প্রেসিডেন্ট হওয়াটাও অসম্ভব নয়। এটা এখন আর কোনো অলীক দিবাস্বপ্ন নয়।

অবশেষে বাইডেনের জয়ের সংবাদটি যখন প্রকাশিত হলো, তখন ওয়াশিংটন ডিসিতে আমার প্রতিবেশীরা বিজয় উদ্যাপনে উচ্ছ্বাস-আনন্দে ফেটে পড়লেন। লোকজন আনন্দে চিত্কার করছিল এবং অপূর্ব কোলাহলে মেতে উঠেছিল, গাড়িগুলো হর্ন বাজিয়ে উল্লাসে শরিক হচ্ছিল, আতশবাজির ছটায় অপূর্ব হয়ে উঠছিল রাতের অন্ধকার আকাশ। এত সব আনন্দ প্রকাশের বহর দেখে স্পষ্টই এটা বুঝতে পারছি যে, আমরা সবাই একসঙ্গে কতটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং একটি সুসংবাদ, সুখ এবং ঘৃণাহীন কিছু গ্রহণ করার জন্য আমরা সবাই ভেতরে ভেতরে কতটা মুখিয়ে ছিলাম! আর এই আনন্দের ফল্গুধারার ক্ষেত্র এতদিন ধরে ক্রমশ প্রস্তুত হচ্ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্ণবাদ ও মিথ্যাচারের বিপরীতে।

এটা ঠিক যে আমেরিকার এগিয়ে যাওয়ার রাস্তাটি সব সময় মসৃণ এবং গোলাপ ফুলে ঢাকা নয়। কারণ অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন ছিল এটি। বাইডেন সহজে জিততে পারেননি। এটা তো মিথ্যা নয় যে, ট্রাম্প যেই বিভাজননীতি ও ঘৃণা নিয়ে চলেন, দুঃখজনকভাবে আমেরিকার অনেকেই, সমস্ত সহিংসতা সত্ত্বেও, ট্রাম্পের পাশেই ছিলেন। এমনকি কোভিড নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ এবং এই রোগে দুই লক্ষাধিক আমেরিকানের মৃত্যুর পরও অনেকেই ট্রাম্পকে আরো চার বছরের জন্য নির্বাচিত করতে ভোট দিয়েছিলেন। ট্রাম্পের এসব সমর্থক খোলাখুলিভাবেই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে আধিপত্যের সঙ্গে বজায় রাখার পক্ষে ছিলেন। এটা অত্যন্ত পরিতাপের ও বিব্রতকরও বটে, যখন আমরা দেখতে পাই আমেরিকার ভাবমূর্তিকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, আমেরিকাকে বিভক্ত ও দুর্বল করা সত্ত্বেও লাখ লাখ আমেরিকান এখনো ট্রাম্পকে সমর্থন করে যাচ্ছেন।

তবে আজ আমেরিকার পদস্খলন ঘটেনি, বেশির ভাগ আমেরিকান সঠিক ব্যক্তিকেই পছন্দ করেছেন। যদিও এই বিজয় ছিল অল্প ব্যবধানের। তবে সঠিক পছন্দটি শেষ পর্যন্ত বিজয় অর্জন করতে পেরেছে এবং আপনারা দেখতে পেয়েছেন আমেরিকার মানুষ কীভাবে রাস্তায় নেমে বিজয় উত্সবে মেতে উঠেছে।

ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউভিএ) রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ল্যারি সাবাতো টুইট করে বলেছেন, ‘অভিজ্ঞতা নামক বিষয়টিকে রাজনীতি ছাড়া প্রতিটি ক্ষেত্রেই সম্মান করা হয়। হ্যাশট্যাগ (#) প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট-বাইডেন শোনার সময় আমরা এটাও স্মরণ করতে পেরেছি যে, বাইডেনের দীর্ঘদিনের গভীর অভিজ্ঞতাটাই তার সবচেয়ে বড় শক্তি। তিনি এমন একজন প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন, যার নতুন করে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়বে না। বিশেষ করে জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে অনভিজ্ঞ কাউকে প্রশিক্ষিত করার মতো সময় এ জাতির হাতে নেই।’

আমেরিকা হয়তো একটি জাতি হিসেবে সংকটের মধ্যে রয়েছে, কিন্তু বহুদিন পর প্রথমবারের মতো আমেরিকা সঠিক পথে যাত্রা শুরু করল। বস্তুত, সঠিক নেতৃত্ব সব সময়ই দিগন্তপ্রসারী হয়ে থাকে।

প্রিয় আমেরিকা, সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য স্বাগত। এতদিন আমরা তোমাকে মিস করেছি।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: তাপস কুমার দত্ত

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন