শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

দেশপ্রেম মানেই সত্য-সুন্দর

আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ২৩:০২

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ৩০ লাখ শহীদের তাজা রক্ত আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের বিজয়। স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত চির উন্নত পতাকা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুদক্ষ নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় এ বিজয়। স্বাধীনতা লাভের পর মাত্র ১০ মাস অতিবাহিত হতে না হতেই আমরা পেয়েছি একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান। আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি, দিক নির্দেশক। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা যার মূলনীতি।

বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন সকল ধর্মের মানুষের জন্য একটি নিরাপদ, বাসযোগ্য ও উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। যেখানে থাকবে না কোন ধর্মীয় সংঘাত। সকল ধর্মের মানুষের জন্য একটি সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্নই দেখেছিলেন তিনি। কারণ বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন যার মধ্যে ন্যূনতম সাম্প্রদায়িকতা আছে সে বন্য পশুর চেয়েও অধম। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও আমাদের কর্ম, আচরণে সাম্প্রদায়িকতা স্পষ্ট। এমন বাংলাদেশ আমরা চাইনি কখনোই। ধর্ম, শিক্ষা-সংস্কৃতির মেলবন্ধনে একটি সুন্দর সমাজ চেয়েছিলাম আমরা। যেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থাকবে। থাকবে নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা।

এ দেশ কৃষক-শ্রমিক, মুণি-ঋষি, জ্ঞানী-গুণীর। এ দেশ ফকির, দরবেশ, পীর-আউলিয়া, আউল-বাউল, লালনের। রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি শ্রেণিই এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁদের প্রতি আমাদের অনেক ঋণ। তাঁদের স্মৃতি সংরক্ষণ আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মকে এ ইতিহাস জানান দিতে, রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ গড়ে তুলতে অনস্বীকার্য।

এ দেশে পবিত্র কোরআনের ভাস্কর্য হওয়াটা যেমন সৌন্দর্যের, কৃষ্ণ-কালি-যিশু-বুদ্ধ, শঠান দেহে তর্জনী উঁচু করা জাতির পিতা, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো নজরুল, একতারা হাতে উদাস মনের বাউল, জেগে থাকা অপরাজেয় বাংলা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী রাজু, শাপলা-দোয়েল-বলাকা-বক চত্বর, দুরন্ত, মিশুক মনিরের স্মৃতি বয়ে চলা সফেদ মাইক্রোবাসের নীরব ভাষা, জাগ্রত চৌরঙ্গী, সংশপ্তক, দুর্জয়, রক্তধারার মত সহস্র স্থাপনা সে সৌন্দর্যকে পরিপূর্ণ করে। জানান দেয় আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের।

এদেশে বিদ্যমান যে সকল ভাস্কর্য রয়েছে তা একদিনে তৈরি হয়নি। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের অংশ হিসেবে এ দেশের কৃষ্টি-কালচারের স্মারক হিসেবে নির্মিত হয়েছে।

সম্প্রতি বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠী ভাস্কর্য নির্মাণ বিরোধী আওয়াজ তুলেছে। যার নেতৃত্বে আছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। অবশ্য তাদের দাবিটা শুধু ভাস্কর্য বিরোধী নয়, স্পষ্ট করে যদি বলি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ বিরোধী। তাদের এহেন আচরণ ও উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড দেখে মনে প্রশ্ন জাগে। মাওলানা মামুনুল হকই কি বাংলার মাটিতে জন্ম নেয়া একমাত্র আলেম? নাকি তার পূর্বে আরো আলেম এ বঙ্গদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন? বাংলাদেশ সৃষ্টির পর থেকে অদ্যাবধি শতশত বুজুর্গ, আলেমে-দ্বীন, পীর-মাশায়েখ এ দেশে জন্ম নিয়েছেন। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ইসলামি ফতোয়া দিয়েছেন। ধর্মীয় বাণী প্রচার করেছেন। তাদের জীবদ্দশায়ও এ সকল ভাস্কর্য এ দেশে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু তারা কেউই তো বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বিরোধী এমন আন্দোলনের ডাক দেননি। তাহলে কি মামুনুল হকরা পূর্বসূরিদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত? নাকি তাদের ধর্মপ্রীতি পূর্বসূরিদের চেয়ে বেশি? উত্তরটা স্পষ্ট। কোন বিশেষ গোষ্ঠী কিংবা মহলের মদদপুষ্ট হয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তাদের এ প্রয়াস। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি যেখানে উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার মাত্র।

কিন্তু তাদের আশায় গুড়েবালি। দেশপ্রেমিক জনগণ, স্বাধীনতাকে মননে-মগজে ধারণ করা প্রজন্ম তাদের এ অযৌক্তিক আহবানে সাড়া দেয়নি৷ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

বিজয়ের মাসে শহর-গ্রামের অলিগলি ছেয়ে যাবে লাল-সবুজ পতাকায়। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মসজিদ, হিন্দুদের মন্দির, খ্রিস্টানদের গির্জা, বৌদ্ধদের প্রার্থনা সভায় প্রার্থনা হবে বঙ্গবন্ধুসহ সকল শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনায়। স্কুলগামী শিশুর সকাল শুরু হবে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসির’ সূর মূর্ছনায়। যে শিশু নেতৃত্ব দেবে আগামীর বাংলাদেশের। বয়োবৃদ্ধ জ্যেষ্ঠ নাগরিকের হাতে শোভা পাবে বিজয় পতাকা। দিনশেষে তিনিও হয়তো ঘরে ফিরে ইবাদতে মশগুল হবেন স্রষ্টার আরাধ্য কামনায়। কারণ, তিনি জানেন মামুনুল হকদের অন্তঃসারশূন্য আস্ফালন স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার মাত্র।

উগ্রবাদীটা স্রষ্টার নৈকট্য লাভের কোন উপায় নয়। পক্ষান্তরে মামুনুল হকদের মত ধর্ম ব্যবসায়ীর আস্ফালন ভার্চুয়াল দুনিয়ার তর্জন-গর্জন আর সগোত্রীয় অনুসারীদের ঔদ্ধত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে এক পর্যায়ে মুখ থুবড়ে পড়বে নিরাশার ঘোর অমানিশায়। কারণ, ঔদ্ধত্য-ব্যর্থতা সহোদর, দেশপ্রেম মানেই সত্য-সুন্দর!

লেখক: সাবেক পরিবেশ বিষয়ক উপ-সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সাংসদ।

ইত্তেফাক/বিএএফ
 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন