বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ইসলাম প্রচারে সাবলীল ও মনোমুগ্ধকর শব্দ চয়ন জরুরি

আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:২০

ইসলামি জীবনদর্শনের অন্যতম সৌন্দর্য হলো জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার সঙ্গে সুন্দর ভাষার সাবলীল চিত্তে কথা বলা। রাসুল (স.) ইসলাম প্রাপ্তির আগে ও পরে সাবলীল ভাষায় মানুষের সঙ্গে কথা বলতেন। তার কথা বলার ধরন ও শারীরিক বাচনভঙ্গি সবার হূদয় ছুঁয়ে যেত। মানুষের চিত্তকে প্রভাবিত করার জন্য মাধুর্যমণ্ডিত কথা বলার ধারা রপ্ত ও চর্চা করা ‘দায়ি’দের জন্য অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান জটিল সমীকরণের বিশ্বে সুন্দর ও মাধুর্যমণ্ডিত কথা দ্বারাই কেবল মানুষের হূদয় জয় করা যেতে পারে। হিংসা, উগ্রতা বা অন্যের ঘৃণা প্রকাশ ইসলামি নৈতিকতা সমর্থন করে না। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে দাওয়াহ বিজ্ঞানের কারিক্যুলামে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে ইসলামকে উত্তম রূপে প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে সমাজ, জাতি ও পরিস্থিতির আলোকে বক্তৃতা উপস্থাপনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

জাহেলি আরব সমাজের সবাই রাসুল (স)-এর মাধুর্য এক বাক্যে স্বীকৃতি দিয়েছে। চরম বিরোধী ও শত্রু হওয়ার পরেও আবু সুফিয়ান অমুসলিম অবস্থায় হিরাক্লিয়াসের দরবারে রাসুল (স)-এর সুন্দর ব্যবহার ও আচার-আচরণের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। রাসুল (স) মদিনা আগমনের সময় ইহুদি নেতা সালাম বিন আবদুল্লাহ রাসুল (স) সৌন্দর্য ও স্মিতভাষী মাধুর্যের কথা তার কওমের কাছে অকপটে স্বীকার করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (স) সব সময় হাসিমুখে কথা বলতেন। তিনি কখনো মুখ কালো করে থাকতেন না। এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-ব্যথাগুলো তার কথা ও আচরণে প্রকাশ করতেন না। আবদুল্লাহ ইবনে হারেস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (স.) অপেক্ষা অধিক মুচকি হাসতে আর কাউকে দেখিনি।’ (মুসনাদে আহমদ :১৭৭৪০) জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর থেকে রাসুল (স) আমাকে তার দরবারে উপস্থিত হতে বাধা দিতেন না এবং আমাকে দেখলেই তিনি মুচকি হাসতেন।’ (বুখারি :৩৮২২) রাসুল (স) সব সময় বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। তিনি ছিলেন সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও আলংকারিক ভাষার কৃতিত্বধারী। তার শব্দ ও বাক্য, উচ্চারণ ও ভঙ্গিমা সবকিছুই ছিল—বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ; অলংকার শাস্ত্রের মধ্য গগন। এ বিষয়ে হাদিসে এসেছে, ‘রাসুল (স) ছিলেন আরবের সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভাষী।’ (কানজুল উম্মাল : ৩৫৪৭১)

রাসুল (স) কথা বলার সময় যেমন তাড়াহুড়া করতেন না, তেমনি এত ধীরে বলতেন না যাতে কথার ছন্দপতন হয়। বরং প্রতিটি কথা স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতেন। আয়েশা (রা) বলেন, ‘রাসুল (স) তোমাদের মতো এক নাগাড়ে তাড়াহুড়া করে কথা বলতেন না; বরং তিনি প্রতিটি কথা পৃথক পৃথক স্পষ্ট ভাষায় বলতেন। যাতে তার পাশে উপবিষ্ট ব্যক্তিরা তা হূদয়ঙ্গম করতে পারে।’ (তিরমিজি : ৩৬৩৯) রাসুল (স) যখন কোনো মজলিসে কথা বলতেন, তখন গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো তিনবার পর্যন্ত পুনরাবৃত্তি করতেন। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসুল (স) তার কথাকে তিনবার পর্যন্ত পুনরাবৃত্তি করতেন, যেন তা ভালোভাবে বোঝা যায়। ’ (তিরমিজি : ২২২)

রাসুল (স.) পারস্পারিক আলোচনার সময় অন্যের কথা মনোযোগসহ শুনতেন। অপরজন চেহারা না ফেরানো পর্যন্ত তিনি তার দিক থেকে চেহারা ফেরাতেন না। আর কেউ তাকে কানে কানে কিছু বলতে চাইলে, তার কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি মাথা সরাতেন না। পারস্পারিক আলাপচারিতার সময় কারো মুখ থেকে কোনো অসঙ্গত কথা বেরিয়ে গেলে তিনি সরাসরি তার নাম উল্লেখ করে লজ্জা দিতেন না; বরং তাকে এভাবে সতর্ক করতেন যে, মানুষের কী হলো যে তারা এমন কথা বলে বা এমন কাজ করে।

শীতের কালকে ইবাদতের বসন্তকাল বলা হয়। অন্যান্য কার্যক্রমের সঙ্গে এ মৌসুমে সারা বাংলাদেশে ইসলামি জলসা তথা মাহফিল হয়ে থাকে। অনেক শ্রদ্ধেয় ও বিজ্ঞ ইসলাম প্রচারক এসব মাহফিলে বক্তৃতা দিয়ে থাকেন। নিশ্চয়ই তারা অনেক ভালো কথা বলে সমাজকে কলুষতা মুক্ত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব মাহফিলের ঐতিহ্য রক্ষা করা একান্ত জরুরি, ওয়াজের গাম্ভীর্য নষ্ট হয় এমন হালকা আচরণ বা কথাবার্তা বলা থেকে বিরত থাকা ‘দায়ি’দের জন্য অপরিহার্য। এসব মহাফিলে কথা বলার সময় রাসুল (স)-এর কথার আদবের কথা স্মরণ রাখতে হবে। অতি আবেগে এমন কথা বলা উচিত হবে না, যাতে অপরের মর্যাদা হানি হয়, কোনো ব্যক্তি, সমাজ বা গ্রুপ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মনে রাখতে হবে, একজন ‘দায়ি’র দায়িত্ব কেবল কোরআন-হাদিসের আলোকে যুক্তিপূর্ণ নছিহত করে যাবেন, হেদায়াতে দায়িত্ব আল্লাহর। আল্লাহ আমাদের ভালো কথা বলার তৌফিক দিন।

লেখক :অধ্যাপক, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

ইত্তেফাক/টিআর

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন