‘এ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের নারী কবিতাটির লাইনগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মানব সভ্যতা বিনির্মাণে কিংবা আধুনিক পৃথিবীর উন্নতিসাধনে নারীর সমান অংশীদারিত্বের কথাকে। আপাতদৃষ্টিতে, তা স্পষ্ট না মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে, গভীর দৃষ্টিপাত করলে সহজেই অনুমেয় হবে যে কারোরই। প্রতিটি অর্জনের পেছনে পুরুষকে প্রেরণা-উত্সাহ যুগিয়েছে নারী, নারীর সেই প্রেরণা আর ভালোবাসা পেয়ে মহাপুরুষগণ করেছেন বিশ্বজয়। আদি মানব হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে ইতিহাসের মহামানবদের জীবনী বিশ্লেষণ করলে আমরা সেই তথ্য সহজেই পেয়ে থাকি।
যুগ থেকে শতাব্দী, শতাব্দী থেকে সহস্রাব্দ পেরিয়েছে, নতুন পুরোনো সভ্যতার গমনাগমনে যুগে যুগে নারীর মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। মানবিক মর্যাদা, সাম্য ও নারীর প্রতি সম্মানের মতো বিষয়গুলো থেকে নারীকে বঞ্ছিত করা হয়েছে বারবার। আধুনিক সভ্যতার নতুনতম সময় পার করা আমাদের সমাজব্যবস্থাও নারীকে তার প্রকৃত সম্মানের আসন দিতে পারছে না। এর বদলে নারীর প্রতি সহিংসতামূলক অপরাধ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। যৌন-নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণের খবর এখন আমাদের পেপার-পত্রিকাগুলোর নিয়মিত পাতায় স্থান করে নিয়েছে। এগুলো বন্ধে নতুন নতুন কঠোর আইন তৈরি করেও ঠেকানো যাচ্ছে না। আবার ধর্ষণের শিকার কোনো নারীর আইনি প্রতিকার লাভে বিচারপ্রক্রিয়ায় রয়েছে যথেষ্ট হয়রানি।
সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া বাংলাদেশে নির্মিত নবাব এলএলবি নামক বাংলা সিনেমার একটি দৃশ্যে দেখা যায়, ধর্ষণের শিকার একজন তরুণীকে থানায় পুলিশের কাছে জবানবন্দি দেওয়ার সময় আপত্তিকর এবং অশ্লীল জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশকে হেয় করার অপরাধে ও পর্নোগ্রাফিক আইনে পরিচালক ও অভিনেতাকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে কিছুদিন আগে। তাদেরকে যে অভিযোগেই গ্রেফতার করা হোক না কেন আমাদের থানাগুলোর বাস্তব চিত্র সিনেমার সেই দৃশ্য থেকে খুব বেশি ভিন্ন কিছু না।
একজন ধর্ষিতা নারী ও শিশু যে ধরনের শারীরিক বা মানসিক পীড়ায় ভোগে তাকে বলে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার (পিটিএসডি)। ভয়াবহ কোনো অভিজ্ঞতা হলে বা যুদ্ধে গেলে সাধারণত এই সমস্যাটি হয়ে থাকে। একজন ধর্ষিতার জন্য এমন উত্পীড়িত, নির্জীব, ভয়ংকর অবস্থায় থেকে প্রতিকার পাওয়া খুবই কষ্টকর হয়। পুলিশ, ডাক্তার আর রাষ্ট্রপক্ষের অনেকের মধ্যে অবিশ্বাস আর নারীর দোষ খোঁজার মানসিকতা তো থাকেই। প্রতিকার লাভের জন্য প্রতিটি স্তরে যুদ্ধ করে আগাতে হয় ভিকটিমকে। জবানবন্দি দিতে হয় পুরুষ পুলিশ কর্মকর্তার কাছে, ডাক্তারি পরীক্ষায় ভুক্তভোগীর পুরো শরীরে ও যৌনাঙ্গের ভেতরে ও বাইরে আলামত খোঁজা হয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, নারী ফরেনসিক ডাক্তারের অভাবে এসব পরীক্ষাগুলোও করে থাকেন পুরুষ ডাক্তাররা । এতে একজন নারীর আত্মসম্মান, মর্যাদার যতটুকু বাকি থাকে তারও শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে যায়।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২০ (৬) ধারায় বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কিংবা ট্রাইবুনাল স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত মনে করলে, এই আইনের ৯ ধারার অধীনে অপরাধের বিচার কার্যক্রম রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠিত করতে পারবে। কিন্তু অপেক্ষমাণ মামলার জটে নাভিশ্বাস ওঠা বিচার বিভাগের পক্ষে ভুক্তভোগী নারীকে সেই সুযোগটুকু দেওয়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না।
ধর্ষণের মতো অতি স্পর্শকাতর একটি মামলার বিচারপ্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে নারীকে যথাযথ প্রতিকার দেওয়ার বদলে তার আত্মসম্মানবোধ, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার এবং সামাজিক মর্যাদাকে সংকুচিত করছে মারাত্মকভাবে। অপরাধীরা প্রতিনিয়ত ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। সেই প্রভাব গিয়ে পড়ছে দেশের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থার ওপরেও। অপরাধের প্রতি সহনশীলতা ক্রমশই বাড়ছে। ফলে অপরাধ সংগঠনের ক্ষেত্রে অপরাধীদের পরোক্ষ উত্সাহ তৈরি হচ্ছে।
এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বিচারপ্রক্রিয়ায় নারীদের মান-মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে কঠোর আইনের যথাযথ প্রয়োগ সুনিশ্চিত করতে পারলে বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি আশা করা যায়। সেই সঙ্গে সুশিক্ষা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা সমাজ থেকে সব ধরনের অপরাধ হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি।
লেখক :শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।