শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

হিমালয়ের পানি নিয়ে যুদ্ধের আশঙ্কায় ভারত ও চীন

আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:১৩

সীমান্ত অঞ্চল নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্ব থেকে সরে আসছিল চীন-ভারত। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বতশ্রেণী হিমালয় অঞ্চলের পানি প্রবাহ নিয়ে অস্থিতিশীল সংঘাত ও চীনের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

ইয়ারলুং জাংবো নদীর উপর চীনের মেগা বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা থেকেই এই ইস্যুর শুরু। চীনের ইয়ারলুং জাংবো নদী তিব্বত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে ব্রহ্মপুত্র নামে।

এশিয়া টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের ব্রহ্মপুত্র নদকে ইয়ারলুং জাংবাও বলা হয়, যার ওপরে বিশাল বাঁধ নির্মিত হবে। এই নদীটি তিব্বতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, যখন এটি ভারতে প্রবেশ করে, তখন তাকে বলা হয় ব্রহ্মপুত্র। ভারত ও বাংলাদেশের সাথে আলোচনা বা পানি ভাগাভাগি না করেই ইয়ারলং ঝাংবাও বাঁধ বাস্তবায়ন করবে চীন। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ইয়াংসি নদীর তীরে তিনটি বড় বাঁধ নির্মিত হচ্ছে, যা চীনে তিনগুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। ব্রহ্মপুত্র নদ এবং হিমবাহের উদ্ভব চীন থেকেই হয়েছিল।

আরো পড়ুন: উপসাগরীয় সংকট নিরসন: কাতারকে শক্তিশালী করবে

চীন যেহেতু ওপরের প্রান্তে রয়েছে তাই এটি আরও ভাল অবস্থানে রয়েছে এবং এটিকে অবরুদ্ধ করে পানির প্রবাহকে নিচে প্রবাহ বন্ধ করতে পারে। এই বাঁধটি নির্মাণ করা ভারতসহ প্রতিবেশীদের সাথে চীনের সম্পর্ককে জোরদার করতে পারে। চীন মেকং নদীর উপর এগারোটি মেগা-বাঁধ তৈরি করেছে, যার ফলে মিয়ানমার, লাওস, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামে পূর্ব নোটিশ ছাড়াই সেখানে পানির স্তর ব্যাপকভাবে ওঠানামা করছে।

প্রতিবেদন অনুসারে ডিসেম্বরের শেষের দিকে, দক্ষিণ ইউনান প্রদেশের জিংহং শহরের নিকটে মেগা বাঁধের সরঞ্জাম পরীক্ষা করার জন্য একটি বাঁধ থেকে পানি হ্রাস করে ১৯০৪ ঘনমিটার থেকে এক হাজার ঘনমিটার করে নিয়েছে চীন। চীনকে এই প্রবাহের অববাহিকার বিষয়ে অবহিত করতে অন্যান্য দেশগুলোর সময় লেগেছে প্রায় এক সপ্তাহ। থাইল্যান্ডের চিয়াং সায়েনে পানির স্তর ইতিমধ্যে এক মিটার নেমে গেছে।

আন্তর্জাতিক পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের যে ৪০০ কোটি মানুষ সামনের দিনগুলোতে পানির সম্ভাব্য সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে, তার অর্ধেকই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতোই এ ক্ষেত্রে উদ্বিগ্ন ভারত ও চীন। উভয় দেশেই পানির চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু প্রাপ্যতা বাড়ছে না। ফলে মাথাপিছু ভোগ কমছে। এই দুই দেশের অনেক স্থানেই বিশুদ্ধ পানির দাম এখন দুধ বা ফলের রসের চেয়ে কম। মুম্বাইভিত্তিক ‘স্ট্র্যাটেজিক ফোরসাইট গ্রুপ’ বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ ভারতে অন্তত ৩০ শতাংশ এবং চীনে অন্তত ৫০ শতাংশ ধান উৎপাদন কমবে পানির অভাবে।

আরো পড়ুন: বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের দিকে নজর রাখছে ভারত ও চীন

বিশ্লেষকরা ধারণা করেন যে ব্রহ্মপুত্রের পানি ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়েরই জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই অঞ্চলের সান্নিধ্য কৃষিকাজের উপর নির্ভর করে। ভারত ও বাংলাদেশ উদ্বেগ অব্যাহত রেখেছে যে রাজনৈতিক বিরোধের পরিস্থিতিতে চীন এই বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে দিতে পারে বা স্রোতধাবন করতে পারে।

ইয়ারলুং জাংবাও বাঁধ নকশার সাহায্যে ভারতের সাথে একই রকম গতিশীল সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছে চীন। তবে যদি জল-ভাগাভাগির চুক্তিতে না পৌঁছাতে পারে তবে বাঁধটি ভবিষ্যতে সমঝোতার চেয়ে দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ হতে পারে।

২০১৭ সালে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ বিষয়ে চীন সময়মতো তথ্য না দেওয়ায় তাদের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের চারটি প্রদেশে তিন কোটি মানুষ অনেক ক্ষতির শিকার হয়েছে। অন্তত ৬০০ জন মারাও গেছে। এসব অভিযোগের সঙ্গে দিল্লি এই উদ্বেগও যুক্ত করেছে, চীন ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে বলে তার অনুমান। বিশেষ করে এ বছর আসামে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে নদীটির প্রবাহের অবিশ্বাস্য হ্রাস-বৃদ্ধি প্রমাণ করে, যান্ত্রিক উপায়ে প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ভারতের দাবি, ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথ্য আদান-প্রদান করতে চীনের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে তার। চীন কর্তৃক প্রয়োজনীয় তথ্য না দেওয়া তাই বড় অন্যায়।

ভারতীয় দাবিতে সত্যতা আছে। ২০০৬ সালে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহসম্পর্কিত তথ্যবিনিময়ের একটি চুক্তি হয় দুই দেশের মধ্যে। ২০১৩ ও ২০১৬ সালে প্রবাহ তথ্য বিষয়ে উপরিউক্ত ধাঁচের আরও ‘মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ স্বাক্ষর হয় শতদ্রু নদীকে অন্তর্ভুক্ত করে। এসব চুক্তি ও সমঝোতার মূল বিষয় হলো প্রতিবছর ১৫ মে থেকে ১৫ অক্টোবর সময়ে ভারতকে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহের উত্থান-পতন সম্পর্কিত তথ্য দেবে চীন, বিনিময়ে অর্থও নেবে। কিন্তু ভারত অর্থ দিয়েও তথ্য পায়নি।

আরো পড়ুন: সেনাবাহিনীর ওপর ভর করে ক্ষমতায় আসতে চায় পাকিস্তানের বিরোধী দল

ভারতীয় সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় এবং বেসরকারী থিংক ট্যাঙ্ক ও নয়া দিল্লি ভিত্তিক নীতি গবেষণা কেন্দ্র থেকে মন্তব্য করা হয়েছে যে, বাঁধটি নদীর তলদেশের জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এদিকে চীনের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশেও, ইয়ারলুং জাংবাও বাঁধকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ করা হয়েছে।

ভারতের ধর্মশালা-ভিত্তিক গবেষণা কেন্দ্র তিব্বত পলিসি ইন্সটিটিউটের ফেলো ডেচেন পালমো সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, ‘গত ৭০ বছরে চীনে ৮৭ হাজারের বেশি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বাঁধ থেকে ৩৫২ দশমিক ২৬ গিগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়— যা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ব্রাজিলের মোট উৎপাদিত জলবিদ্যুতের চেয়ে অনেক বেশি।’

এসব বাঁধ নির্মাণের ফলে ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৫০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চীন যে সব বাঁধ নির্মাণ করেছে সেগুলোর মধ্যে প্রায় ২২ হাজার বাঁধের উচ্চতা ১৫ মিটারের বেশি। এর ফলে এশিয়ার অন্য দেশগুলো কি পরিমাণ সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত হয়েছে তা কল্পনাও করা যায় না। এতো উঁচু বাঁধের কারণে ভাটি অঞ্চলে বনভূমি, জলাভূমি ও তৃণভূমি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি জলজপ্রাণীর জীববৈচিত্র্যও নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাইকেল বাকলে।

আরো পড়ুন:  ব্রহ্মপুত্রে বাঁধ নিয়ে যুদ্ধে জড়াতে পারে ভারত-চীন 

লাদাখের দ্বন্দ্বের পর ১১২৬ কিলোমিটার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণের লাইন ধরে চৌকি স্থাপন করেছে ভারত। চীন-নিয়ন্ত্রিত তিব্বত থেকে পৃথক করেছে অরুণাচলকে। তার অংশ হিসাবে, চীন একটি রেলপথ নির্মাণ শুরু করেছে যা অরুণাচল সীমান্তের সমান্তরালভাবে চলবে এবং চীনের সিচুয়ান প্রদেশের চেঙ্গদু শহরকে তিব্বতের লিনজির সাথে সংযুক্ত করবে। এটি দ্বিতীয় রেলপথ প্রকল্প হবে যা তিব্বতকে বাকী চীনের সাথে সংযুক্ত করবে, এটি প্রথম চিংহাই প্রদেশের জাইনিং থেকে তিব্বতের রাজধানী লাসা পর্যন্ত লাইন, যা ২০০৫ সালে শেষ হয়েছিল।

কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্রের বরাত দিয়ে গ্লোবাল টাইমস এক রিপোর্টে বলে, নতুন রেল লাইনটি "কেবল তিব্বত অঞ্চলের সামগ্রিক অর্থনৈতিক বিকাশকে ত্বরান্বিত ও বর্ধন করবে না, তবে সীমান্তের স্থিতিশীলতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।"

চীন যদি তার ইয়ারলুং জাংবো বাঁধ প্রকল্পটি নিয়ে এগিয়ে যায় তবে এশিয়ার এই দুই শক্তি ১৯৬২ সালের মতো পুনরায় সংঘর্ষে জড়াতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে।

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন