শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে নৈতিক মূল্যবোধের প্রয়োজন

আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২১, ০৪:২৩

স্বাধীনতার পরে আমাদের অনেক অর্জন আছে, এটা স্বীকার্য। কিন্তু বেদনাদায়ক অনেক ব্যাপারও আছে, তা পাশ কাটিয়ে বা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশটাকে যখন বিশ্বে সম্মানের শিরোপায় প্রতিষ্ঠিত করছেন, দেশের সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাচ্ছেন, মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন যখন পূর্ণ হওয়ার পথে, তখন একশ্রেণির লোক দেশটাকে পেছনের দিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে, পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন অপকাণ্ড ঘটিয়ে দেশের অর্জিত সুনাম ক্ষুণ্ন করার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। 

দুঃখ এখানেই, যে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু—সেই দেশের রাজনীতিতে অপধারার অপরাজনীতি ঢুকে বিষবৃক্ষ তৈরি করছে। এ সময়কালের রাজনীতিকরা কি সত্যি দেশটাকে বঙ্গবন্ধুর মতো ভালোবাসেন?

যে দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করেন—তাদের একটা শ্রেণি ভবিষ্যতের জন্য এদেশ নিয়ে চিন্তা করেন না। ভাবা যায়, সেজন্য আগেভাগেই বিদেশে বাড়ি কেনেন, ব্যাংক ব্যালেন্স করেন, নিজেদের সন্তানদের বিদেশে পড়ালেখা করান। শিল্পপতিরাও অনেকেই বিদেশে বাড়ি কেনেন, সেখানে থাকেন, আবার এদেশে ব্যবসার মূল শেকড়টি ঠিকই ধরে রাখেন। এদেশে আসা-যাওয়ার ভেতর থাকেন। তাদের সন্তানেরা সেদেশে লেখাপড়া করে, সেখানেই স্থায়ীভাবে বাস করেন, এসব ব্যবসায়ী রাজনীতিক পরবর্তীকালে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এসব ছেলেমেয়ে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জানে না। জানার প্রয়োজনও মনে করে না। জানানোরও প্রয়োজন মনে করেন না তাদের রাজনীতিক কিংবা ধনী ব্যবসায়ী বাবা-মা। বরং তাদের গর্ব হয়—তাদের সন্তানেরা এসব জানেন না। বিদেশি ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে তারা গর্ব করে।

আরও পড়ুন: শিশুর মানসিক বিকাশ

যে রাজনীতি ব্যক্তিলোভ-লালসা ধারণ করে, প্রতিহিংসাপরায়ণতায় পূর্ণ, যে রাজনীতি নিজের দেশকে নিজেই নিরাপদ মনে করে না—এসব রাজনীতি কোনো দেশেরই দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ঘটাতে পারে না। দেশটা যেন হাত-পা বাঁধা অসহায় এক সুশ্রী নারী—যে যেভাবে পারে তার নিজের মতো করে ব্যবহার করে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। ব্যাপারটি কি তা-ই? তা তো হতে পারে না। দেশে বর্তমানে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ মহামারিতে রূপ নিয়েছে। পত্রিকায় পাতা বা টেলিভিশন—সর্বক্ষেত্রে এই ভয়াবহ মর্মন্তুদ এসব খবর অগ্নিকুণ্ডের মতো আমাদের মন ও মননকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। বিবেককে ক্ষতবিক্ষত করছে। আমাদের মা-বোনেরা তো শিক্ষাদীক্ষায় অনেক এগিয়ে গেছে। বিদ্যাবুদ্ধিতে অগ্রসরমাণ বলেই স্বীকৃত। পৃথিবীতে এখনো রক্ষণশীল প্রাচীন নীতি-নিয়ম, রীতি-রেওয়াজ, প্রথা-পদ্ধতি মানা নারী-পুরুষের সংখ্যা বহুগুণে বেশি। আমাদের সমাজেও তা-ই। এরকম এক সমাজে নারী প্রতিনিয়ত যেভাবে নির্যাতিত হচ্ছে তা খুবই হতাশাজনক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও এর বাইরে নয়। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—সর্বক্ষেত্রে নারী অনিরাপদ। কোথাও নারীকে আর নিরাপদ ভাবা যাচ্ছে না। স্বাধীন বাংলাদেশে এই অসুস্থ সমাজ কারো কাঙ্ক্ষিত ছিল না।

আমাদের স্বপ্ন খুব বেশি নয়। সাদাসিধে সুন্দর নিরাপদ নিশ্চিন্ত জীবন। যেখানে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে কাজ করতে পারি—নিজের শিল্প-সাহিত্য-গবেষণাসহ বহুমাত্রিক সৃজনশীল মননশীল কাজ করতে পারি—নিশ্চিন্ত ঘুমাতে পারি। নিজের পরিবার-পরিজন স্বাভাবিক-স্বাচ্ছন্দ্য জীবন পাবে, আদর্শিক পড়ালেখা করবে, মূল্যবোধ ও নৈতিক জ্ঞানে গড়ে উঠবে, মনে-মননে-চিন্তনে-আবেগে দেশপ্রেম চিরজাগ্রত থাকবে। এটুকুই তো চাই। বাস্তবে তা কি আমরা পাচ্ছি? করোনাকালে আমাদের অর্থনীতি শিক্ষা স্বাস্থ্য সর্বক্ষেত্রে মহামারি বিপর্যয় ও দুর্নীতিতে ভরে গেছে। উচ্চশিক্ষাঙ্গনে শিল্পসাহিত্যচর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে প্রায়, যা চলছে গতানুগতিক ধাঁচের। নতুন দিগন্ত উন্মোচনের কোনো আভাস বা আকাঙ্ক্ষা সেভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ অবস্থা সবচেয়ে বেশি করুণ। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাপকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দিন দিন যত এগোচ্ছে সংখ্যা আরো বাড়ছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়টিতে বাংলা বিভাগ আছে? কয়টিতে বাংলা পড়ানো হয়? শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করা হয়? হাতেগোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ চালু আছে। সেগুলোরও আবার সব কয়টিতে পূর্ণ বাংলা বিভাগ নেই। ইউজিসি বেসরকারি প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সব বিভাগেই ১০০ নম্বরের ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ নামে একটি কোর্স পড়ানো বাধ্যতামূলক করলেও, এটা কয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়? অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ানো হয় না। কেন হয় না? হয় না এ কারণেই—সবার ধারণা বাংলা পড়ে কী হয়? বাংলা আবার পড়ার মতো কোনো ব্যাপার হলো? ও তো আমরা মায়ের পেট থেকে পড়েই জানি। এর চেয়েও যেটা ভয়াবহ, তা হলো বাংলা পড়ালে তো পুঁজি বাড়বে না। ব্যবসা হবে না। ইউজিসির নির্দেশনামা সীমানার বাইরে রাখে—যতদিন চালু না করে পারা যায়। চলছেও এভাবে। দু-একটি ব্যতিক্রম ব্যতীত। অদ্ভুত! ভাবাও যায় না। সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে এভাবে চলছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। নিজের দেশ—নিজের দেশের শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে ন্যূনতম একটা ধারণাও অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় না। কোন সাবজেক্টের বাজারমূল্য বেশি—সেটি চালু করা বা সেটিকেই লালন-পালন করা তাদের ধ্যান-জ্ঞান। সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একবার নড়ে উঠেছিল—যখন হলি আর্টিজান জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল, তার পরপরই সরকার সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সংগীত বাধ্যতার ভেতর এনেছিল। সে সময় বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ চালু করার কথা চিন্তাভাবনা করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা প্রায় পুরোটাই নিভে গেছে। জাতীয় সংগীত তখন অনুষ্ঠানে গাওয়া বা বাজানো হলেও, কিছুদিন পর থেকে সেটাও আর থাকেনি। আগেও অবস্থানে সব ফিরে গেছে। সে সময় বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে—বাংলা ভাষা নিয়ে-বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান লক্ষ করা গেলেও, তাও একসময় জলে ভেসে গেছে। হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ বৈরিতার ভেতরও চলছে। সেখানে কর্তৃপক্ষের কপালে ভাঁজ পড়া অবস্থার ভেতর দিয়েও দেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কিছু কাজকর্ম হয়। সেটাকেও ছোট করে দেখতে চাই না।

আরও পড়ুন: জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনে অব্যবস্থাপনা

এক সময় আন্দোলন-সংগ্রামে গণসংগীত অপরিহার্য ও অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেই গণসংগীত এখন হারিয়েই গেছে বলা যায়। আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাও পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সুস্থ যে ধারায় আগে দাবিদাওয়া তুলে আন্দোলন সংগ্রাম করা হতো, সেখানে গণসংগীত ও বিপ্লবী কবিতা আন্দোলনে নতুন মাত্রা তৈরি করত। এখন আকাশসংস্কৃতি। আমাদের বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্য-সংস্কৃতি-মনন-মনীষার প্রকাশ-বিকাশ গাঢ় ও গভীর হওয়া সত্ত্বেও আমরা তা হারাতে বসেছি। মাতৃভাষার প্রতিটি শব্দের সঙ্গে আমাদের সে নাড়ির সংযোগ রয়েছে, সেই যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এতে আমাদের বুদ্ধি ও বোধশক্তি স্বাভাবিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে।

শিক্ষাঙ্গন হলো আদর্শ-নৈতিকতা-দেশপ্রেম তৈরির সবচেয়ে পবিত্র জায়গা। সেই শিক্ষাঙ্গন বর্তমানে বহুমাত্রিকতা নীতিহীনতায় প্রশ্নবিদ্ধ। অর্থ আত্মসাত্, নিয়োগবাণিজ্য, দলীয় রাজনীতির দাসত্ব পদপদবির জন্য নির্লজ্জ ও ব্যক্তিত্বহীন চাটুকারিতা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ সুস্থ রাজনীতির ধারা শক্তিমত্তার সঙ্গে প্রবলভাবে বিকাশের পথে না এগোলে, অপরাজনীতি ও অপসংস্কৃতি বিষধর সাপের মতো ভয়ংকর হয়ে উঠবে। আদর্শিক চিন্তা-নীতিবোধ-নৈতিকতা-মূল্যবোধ—এসব মগজের ভেতর থেকে বের হয়ে কর্পূরের মতো নিশ্চিহ্ন হয়ে বাতাসে মিশে যাবে। ন্যায়বোধ-শুভবুদ্ধি-নৈতিকতা-দেশপ্রেম এ শব্দগুলো যে শুধু শব্দ নয়—ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য যে সবচেয়ে মূল্যবান, সেটা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। ন্যায়বোধ-নৈতিকতা-আদর্শ এসব মগজে-মননে-চিন্তা ও বোধে গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বর্তমানে ন্যায়-অন্যায় বোধের জায়গায় ভোগবাদী মানসিকতা আর নির্লজ্জ লালসা জন্ম নিচ্ছে। অর্থ আর স্বার্থ এখন ভালোবাসা বা বন্ধুত্বের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যতই নীতিহীন হই না কেন, নিজেদের নীতিমান প্রমাণের জন্য প্রচেষ্টা থাকে সবচেয়ে বেশি এবং এক্ষেত্রে পথটিও বেশ অনায়াসসাধ্য—ধর্মীয় লেবাস ধারণ। অন্ধমোহকে একশ্রেণির রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে পুঁজিপতি সবাই ব্যবহার করেন। এতে সহজেই নিজের সামাজিক অবস্থান, সম্মান, খ্যাতি প্রতিভূ প্রতিষ্ঠিত করা যায় এবং সেটিই ঘটছে। দীর্ঘদিনের লালিত আচরণ-বিশ্বাস, সমাজের নিজস্ব আদর্শ ও নিয়মনীতি, রীতিনীতি ও প্রথা মেনে চলার ভেতর ছিল সম্মানবোধ। এর সঙ্গে জড়িত সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, সর্বোপরি সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত হওয়া বিশেষ কতকগুলো গুণ। মানুষের আত্মিক সামাজিক উত্কর্ষের জন্যে এবং জাতীয় জীবনে উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করার জন্য সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের লালন, চর্চা ও বিকাশের বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

লেখক : বহুমাত্রিক লেখক ও প্রফেসর, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/এমএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন