বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পেশার বৈচিত্র্য বাড়াচ্ছে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা শিক্ষা

আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৫:৩৯

তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক উৎকর্ষের ফলে দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে মানবীয়  যোগাযোগের ধরণ, গতি ও প্রকৃতি। দশকে দশকে প্রযুক্তির ভিন্ন ভিন্ন ধারা আমাদের জীবন যাপনকে নাড়িয়ে দিচ্ছে অভাবনীয়ভাবে ।  মানবীয় যোগাযোগের আধুনিক ধাপসমূহের (মুদ্রণ মাধ্যম থেকে সম্প্রচার ও ইন্টারনেট ভিত্তিক অনলাইন যোগাযোগ) দ্রুত রূপ পরিবর্তনের সাথে আমাদের অভ্যস্ত হতে বেগ পেতে হচ্ছে । 

মিডিয়া কনভারজেন্সের (একীভূতকরণ) কারণে বর্তমানে প্রিন্ট ও সম্প্রচার মাধ্যমের ফারাক ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। সাংবাদিকদের এখন সদা প্রস্তত থাকতে হয় মুদ্রণ মাধ্যমে অর্থ্যাৎ সংবাদপত্রের খবরের পাশাপাশি অডিও ও ভিডিও কিংবা অডিও-ভিজ্যুয়াল আধেয় উপস্থাপন করার জন্য। বর্তমানে সংবাদ মাধ্যমকে আলাদা করা কঠিন। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, মাত্র বছর পাঁচেক আগেও কোন একটি পত্রিকার নাম শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠত একটি নির্দিষ্ট  সংবাদপত্রের অবয়ব, একটি আলাদ চেহারা ও পত্রিকাটির ব্যক্তিত্ব। এখন দৃশ্যপট পাল্টাচ্ছে। সংবাদপত্র আর আগের জায়গায়  নেই, এর রয়েছে অনলাইন সংস্করণ। তাও আবার অডিও ও ভিডিও কিংবা অডিও-ভিজ্যুয়াল সংবাদ  ও  আধেয় দিয়ে ঠাসা।

সংবাদ মাধ্যমের চিরায়ত এ রুপের পরিবর্তন হলেও, তাতে সৃষ্টি  হয়েছে অপার সুযোগ। দিন দিন বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠছে এ পেশা। সংবাদপত্র আগে যেখানে শুধু ছাপানো কাগজ বের করার জন্য অল্প সংখ্যক সাংবাদিক ও কর্মী দিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতো, তাদের এখন অনলাইন সংস্করণে পারদর্শী, অডিও ও ভিডিও কিংবা অডিও-ভিজ্যুয়াল সংবাদ কাভারেজ ও আধেয় তৈরীতে দক্ষ জনবলও দরকার। ইন্টারনেট ভিত্তিক সৃষ্ট নতুন নতুন মাধ্যমের প্রতিযোগিতার সাথে  টিকতেই সনাতনী সংবাদ  মাধ্যম গুলোর অবিরাম এ প্রচেষ্টা। অধিকন্তু, প্রতিষ্ঠিত সংবাদ মাধ্যমগুলো এখন বিষয়-ভিত্তিক বিশেষায়িত প্রতিবেদন (বিট রিপোর্ট) করে নিজেদের আলাদা বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। পশ্চিমা সংজ্ঞানুযায়ী“অপরাধ, অর্থ ও যৌনতা’ই যে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ তৈরী করে-সে ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। নির্বাচন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, আইন ও অপরাধ, ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতি, প্রযুক্তি, জেন্ডার, কৃষি, উন্নয়ন, সংস্কৃতি, মানবাধিকার, জনস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, খেলাধূলা, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি সহ নানা বিষয়ে বিশেষায়িত (বিট রিপোর্ট) প্রতিবেদন কাভার করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞান ও রিপোর্টিং এর কলা-কৌশল সস্পর্কে ভাল ধারণা সস্পন্ন জনবল অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠেছে। এ সকল বিষয়ে সাংবাদিকতা করে অনেকেই ইতিমধ্যে তারকা খ্যাতিও পেয়েছেন।  

করোনা মহামারির শুরুর দিকে মিডিয়ায় উদ্ভূত  সাময়িক যে সমস্যা আমরা দেখেছি তা মূলত: অর্থ সংকটের জন্য নয়, বরংমহামারী মোকাবেলার সক্ষমতার অভাব, মিডিয়ার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সীমাবদ্ধতা ও ব্যবস্থাপনা জনিত ঘাটতির সাথে সম্পর্কিত। করোনার ঝড়ে সাময়িক ধাক্কা খেলেও বাংলাদেশের মিডিয়া শিল্প‘ঝরে’পড়ার মত দূর্বল নয়। বরং, কয়েক মাসের ব্যবধানেই তা আবার স্বমহিমায় ফিরে আসতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশের মিডিয়া  জগত এখন অনেক ব্যাপক, সর্বগামী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বর্তমান এ সময়ে প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনেই নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরী হচ্ছে। দরকার হচ্ছে দক্ষ বাড়তি লোকবলের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মনিটরিং, ‘ফ্যাক্ট চেক’(তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই) এবং মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের সংবাদকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বারা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো-এখন মহাযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। দরকার হচ্ছে সামাজিক মাধ্যম সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান সম্পন্ন জনবলের। সংবাদমাধ্যমের সামাজিক মাধ্যমের প্লাটফর্ম ছাড়াও ব্যক্তিগত ব্যবহারেও অনেকে ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে কনটেন্ট (আধেয়) তৈরী ও পোষ্ট করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠছেন এবং অর্থ উপার্জন করছেন। সম্পাদনাহীন সামাজিক মাধ্যমের কনটেন্ট নিয়ে যথেষ্ঠ আপত্তি ও সমালোচনা থাকলেও একটিমাত্র ফেসবুক পেইজ থেকে যে মাসে লাখ টাকা আয় করা সম্ভব তা অনেকেরই জানা। শুধু প্রয়োজন সঠিকভাবে কনটেন্ট  তৈরী, সম্পাদনা আর ডিজিটাল মার্কেটিং এর কৌশল জানা। অনেক শিক্ষার্থী সাংবাদিকতা ও যোগাযোগ বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে আজ আর ট্রাডিশনাল(সনাতনী) মাধ্যমে কাজ করতে আগ্রহ দেখায় না, বরং নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে সামাজিক মাধ্যমের জন্য কনটেন্ট  তৈরী করে। অনেককেই এখন গর্ব ভরে বলতে শোনা যায় যে তারা ইউটিউবার। এতে তারা ভাল আয়ের সাথে নামও কামাচ্ছেন। এমনও উদাহরণ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  সাংবাদিকতা ও যোগাযোগ বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স  ডিগ্রি  শেষ করে ফেসবুকে রান্নার পেজ চালিয়ে তারকা খ্যাতি অর্জনের পাশাপাশি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হয়েছেন অনেকেই। 

এ তো গেলো সনাতনী ও আধুনিক সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে সৃষ্ট নতুন নতুন পেশার কথা। বিভিন্ন মার্কেটিং ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে, সরকারী, বেসরকারী ও অলাভজনক সংস্থাগুলোতেও দিন দিন বাড়ছে সাংবাদিকতা ও যোগাযোগ বিষয়ে গ্রাজুয়েটদের চাহিদা। জনসংযোগ, লিয়াজো, এডভোকেসি, প্রশিক্ষণ, নেটওয়ার্কিং,  বিজ্ঞাপনকলা, সৃজনশীল লেখা, কাউন্সেলিং, উন্নয়ন যোগাযোগ, গবেষণা ও  কৌশল প্রণয়ণ, আচরণ পরিবর্তন যোগাযোগ- এ সকল ক্ষেত্রে নিয়োগে সাংবাদিকতা ও যোগাযোগ বিষয়ের গ্রাজুয়েটরা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন। অনলাইন মিডিয়া ও  বিভিন্ন ডিজিটাল প্লাটফর্মের ব্যাপক চাহিদা মেটানোর জন্য অডিও-ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট তৈরীতে সক্ষম এমন গ্রাজুয়েটদের চাহিদা বাড়ছে ব্যাপকভাবে। বিশেষ করে যারা নিজেরাই আইডিয়া জেনারেট করতে পারে এবং সে আইডিয়াকে অডিও-ভিজ্যুয়াল ফ্রেমে গল্পাকারে প্রকাশ করতেপারে এমন দক্ষতা সম্পন্ন জনবলের অনেক প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ভিডিও প্রডাকশন সম্পর্কে যাদের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান রয়েছে, ফটোগ্রাফিতে মুন্সিয়ানা রয়েছে তাদের চাহিদাও ব্যাপক। অনেকেই ফ্রিল্যন্সার হিসেবেও ভাল করছেন। 

সৃজনশীল লেখক, কলামিষ্ট, গল্পকার, শিল্পী, পারফর্মার, পাবলিক রিলেশন্স (জনসংযোগ)-পি আর  পেশাজীবী, বিপনন পরামর্শক,ডিজিটাল মার্কেটিং সহ নানা ধরণের কনসালটেন্সির কাজ করছেন। বিসিএস সহ নানা ধরণের সরকারী চাকুরির পাশাপাশি এসকল আধুনিক পরিবর্তিত পেশায় যেতে হলে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক পঠন-পাঠনের সাথে নিজেদের যোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরী। আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি সম্পর্কে ভাল ধারণার পাশাপাশি প্রয়োজন  উপস্থাপনার  দক্ষতা ও সফট স্কিল সম্পর্কে জ্ঞান। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগের সাবলীল সক্ষমতা প্রয়োজন। 

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ যুগের চাহিদা ও ইন্ড্রাষ্ট্রির প্রয়োজনের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের  যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে একেক ধরণের সুবিধা ও বৈশিষ্ট্য। সেজন্য শিক্ষার্থীদের উচিত যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তির সময় শিক্ষকদের  সাথে পরামর্শ করা ও বিভাগটি পরিদর্শন করে ব্যবহারিক সুবিধা সম্পর্কে জেনে নেয়া। তাদের লক্ষ্যটি শেয়ার করা এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নিজস্ব লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাসমূহ মূল্যায়ন করা। 

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ 

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

 

 

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন