বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

চীন ও পাক সেনাদের যোগসাজশে ডুবছে বেলুচিস্তানের জনগণের ভাগ্য 

আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৭:৪৮

চীন ও পাক সেনাদের যোগসাজশে ডুবছে বেলুচিস্তানের জনগণের ভাগ্য। পাকিস্তান ব্যুরো অফ স্ট্যাটিসটিকসের (পিবিএস) জরিপ ও ২০২০ সালে দেশটির স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন থেকে জানা গেছে বেলুচিস্তান প্রদেশের পরিবারপ্রতি আয় ৬,৩৪৬ রুপি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬,৩৮৭ রুপিতে পৌঁছেছে। 'হাউসহোল্ড ইন্টিগ্রেটেড ইকোনমিক সার্ভে' নামের এ জরিপে পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকগুলোর পারস্পরিক তুলনা করা হয়েছে। তবে এতে শুধু নির্দিষ্ট কিছু মানুষেরই হচ্ছে  ভাগ্যোন্নয়ন। আর বেলুচিস্তানের বেশিরভাগ মানুষই ডুবছে দারিদ্রতার অভিশাপে।   

জরিপে দেখা গেছে, দেশটির অন্যান্য প্রদেশের চেয়ে পাঞ্জাব ও বেলুচিস্তান প্রদেশে লক্ষণীয়ভাবে আয় বেড়েছে। একইসঙ্গে, আয় বাড়ার তালিকায় সর্বশেষ স্থানে আছে খাইবার পাখতুনওয়া প্রদেশ। পিবিএসের মতে, এই চমকে দেওয়া ফলাফলের পেছনের কারিগর 'জাদুকরী' চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) এবং এর সাথে সংযুক্ত অন্যান্য বড় উন্নয়নের উদ্যোগ। 

পিবিএস নিশ্চিতভাবেই ইতালিয়ান কবি ত্রিলুসার পরিসংখ্যান বিষয়ক মন্তব্যের কথা জানে না। তিনি বলেছেন, 'যদি জরিপে দেখা যায় আপনি প্রতিমাসে একটি করে আস্ত মুরগি খাছেন কিন্তু বাস্তবে খাচ্ছেন না তাহলে নিশ্চিত থাকুন অন্য কেউ দুটো করে খাচ্ছে'।

 ইউএনডিপির মতে,  বেলুচিস্তানের ৭১% নাগরিক দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। যদি শুধু গ্রামীণ জনপদের কথা ধরা হয় তাহলে এই হিসেব বেড়ে ৮৫ শতাংশতে পৌঁছে যাবে। অন্যদিকে, শুধু শহরের হিসেব করলে কমে ৩৬ শতাংশে দাঁড়াবে। 

আবার কবি ত্রিলুসার কাছে ফিরে যাই। উপরের হিসেবে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কেউ না কেউ নিশ্চিতভাবেই বেলুচদের 'মুরগি' খেয়ে নিচ্ছে। এখানে সিপিইসি'র কথা তুললে সন্দেহ হবে যে এই 'কেউ না কেউ' অবশ্যই চাইনিজ, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং রাজনীতিবিদদের সাথে সংযুক্ত ব্যক্তিবর্গ বা প্রতিষ্ঠান। সিপিইসি'র মুকুটের রত্ন গাওধার এ সন্দেহের অন্যতম উদাহরণ। বেড়া দিয়ে ঘেরা এক 'ওপেন এয়ার' কারাগার হলেও এটা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত পর্যটন কেন্দ্র হতে চলেছে। 

দ্য গাওধার ক্লাব এবং নাইনটি নাইন বিচ রিসোর্ট এখন সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্য হিসেবে পাকিস্তানে প্রচার করা হচ্ছে। এই ক্লাবের ওয়েবসাইট বলছে, 'এটা গাওধার কোস্টাল মহাসড়কের পাশে আরব সাগরমুখী সৈকতে অবস্থিত। এটা তিনদিক থেকে গাওধার ক্যান্টনমেন্ট দিয়ে ঘেরা। ক্লাবের মেম্বারদের জন্য গাওধারে বিশেষ ব্যবসার সুযোগ রয়েছে। এখানে ব্যবসা ও আনন্দ বিলাসবহুল জীবনযাপনের সুযোগ করে দেয়। এই ক্লাবের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের সাথে পাকিস্তানি ব্যবসায়ী সমাজের সংযোগ ঘটানো।'
 
 গাওধার ক্লাবের  ক্লাবের মালিক এএম৯৯ গ্রুপ। এই গ্রুপই গাওধার এলাকার বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে। এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান হলেন ব্রিগেডিয়ার আসিফ মোহাম্মদ মিনহাজ। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হওয়ার পাশাপাশি তিনি বেলুচিস্তান উন্ন্যন কর্তৃপক্ষের উপদেষ্টা ও পরিচালক। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, এখানের এক কণা জমিও সরকারের মালিকাধীন নয়। 

সরাসরি না হলেও সম্ভবত মরিশাসের পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রাজা মাহমুদ, ওয়ালেড শহরের ডিজি কামরান লাসহারি, ব্রিগেডিয়ার আসিফের স্ত্রী রুবিনা আসিফ এবং সাবেক আইনমন্ত্রী আহমের বিলাল সুফি গাওধার ক্লাবের উপদেষ্টা পরিষদে আছেন।

এই কোম্পানির মূল লাহোরে। লাহোরে এক দাতব্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, নাম 'টাবা'। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাও ব্রিগেডিয়ার আসিফ এবং বোর্ড মেম্বার তাঁর স্ত্রী রুবিনা। ২০১৫ সালে বেলুচিস্তানে ভূমিকম্প আঘাত হানার পর ত্রাণকার্যে অংশ নেয় টাবা। এখানে একটা জিনিস খেয়াল করতে হবে যে, ঐ ত্রাণকার্যে শুধু সেনাবাহিনী দ্বারা অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোই অংশ নিয়েছিল। এমনকি তখন অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকেও বেলুচিস্তানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।   

টাবা বিভিন্ন সময়ে আখুয়াট, নাইম আন নাসের ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, মাইল স্টোন, ফালাহ ফাউন্ডেশন, কোরেশী ফাউন্ডেশন, জারার শাহিদ ট্রাস্ট, নাস্ট কমিউনিটি সার্ভিসেস, লুমস কমিউনিটি সার্ভিসেস, রেসকিউ সার্ভিসেস ১১২২ পাঞ্জাব, আল হিজরাহ।'

ব্রিটেনে ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দু'বার আল হিজরাহ'র কার্যক্রম নিয়ে তদন্ত হয়েছে এদের দাতব্য তহবিলের কারণে। তহবিলের কথা বলতে বলতেই আসে গাওধার ক্লাবের সিলভার মেম্বারশিপের কথা। এ ক্যাটাগরিতে লাগবে ৩০০,০০০ পাকিস্তানি রূপি। গোল্ড ও প্লাটিনাম ক্যাটাগরিতে আপনি চাইলেই মেম্বার হতে পারবেন না, শুধুমাত্র জায়গা ফাঁকা থাকলেই পারবেন। 
 
কিছু বেলুচ গাওধার জিমখানা ক্লাব তৈরি করছে। এখানে ন্যূনতম সদস্য ফি ৫০০,০০০ পাকিস্তানি রুপি। এ ধরনের বেলুচরা 'ভিশনারি ওয়ার্ল্ডে' বসবাস করে। অদ্ভুত ব্যাপার, এদের কোম্পানির নামও ভিশনারি ওয়ার্ল্ড। এর মালিক হাজী মোহাম্মদ ইকবাল বেলুচ। 

এরা সম্ভবত প্রদেশটির একমাত্র নাগরিক যারা দৈনন্দিন ঘটনা সম্পর্কে অবগত নয়। প্রদেশটিতে চলছে গুম, খুন, গণকবর, নিউক্লিয়ার টেস্ট এবং অপহরণ। তারা যখন পাকিস্তান আর্মি ও চায়নার জন্য বিলাহবহুল ক্লাব বানাচ্ছে এবং বলছে, বেলুচদের তারা পাকিস্তানের মূলস্রোতের সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করছে তখন বেলুচরা আরও নিষ্পেষিত হচ্ছে। 

ইত্তেফাক/এআর

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন