শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভাষা আন্দোলন ছিল মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাভাস

আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১০:১৯

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ভাষাকে কেন্দ্র করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম বড় বিভেদ তৈরি হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বাংলা ভাষার জন্য উর্দুর মতোই সমান মর্যাদা দাবি করেছিল। ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলা ভাষার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়মতান্ত্রিক অবহেলা ও বাংলা ভাষাকে বাতিলকরণের বিরুদ্ধে বাঙালির রক্তঝরা প্রতিবাদ।

পাকিস্তানের শীর্ষনেতাদের ঘাঁটি ছিল দেশের পশ্চিমাংশে, তাই শাসন ক্ষমতা সেখানেই কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। তবুও রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশাসন, প্রতিরক্ষাসহ সবক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয় পূর্ব বাংলা।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মানি অর্ডার ফর্ম থেকে শুরু করে ডাকটিকিট, মুদ্রা, রেলওয়ের টিকিট ও সরকারি লেটারহেডে একতরফা উর্দু ব্যবহার শুরু করে। পাকিস্তানের দুই অংশেই এই নীতি অপ্রিয় ছিল। উর্দু-বক্তা ও বুদ্ধিজীবীরা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে অন্য সবার চেয়ে বেশি মর্যাদা দিতেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের দুই অংশে মাথাপিছু আয় ছিল সমান, ১৯৭১ সালে পশ্চিমের মানুষের আয় পূর্বের প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। ওই ২৫ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগের অভাবে শত শত স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু পশ্চিমে বেড়ে গেছে তিন গুণ।

দেশে ইসলামী আদর্শ ও ভাবধারা সমুন্নত করার প্রত্যয় নিয়ে ভারত বিভাগের অব্যবহিত পরেই ঢাকায় গড়ে উঠে তমদ্দুন মজলিশ । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর এটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর নামকরণ হয় পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ। তমদ্দুন মজলিশ প্রতিষ্ঠায় অধ্যাপক আবুল কাশেমের অগ্রণী সহযোগীদের মধ্যে ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অধ্যাপক এ.এস.এম নূরুল হক ভূঁইয়া, শাহেদ আলী, আবদুল গফুর, বদরুদ্দীন উমর, হাসান ইকবাল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় সিনিয়র ছাত্র। প্রফেসর আবুল কাশেম ছিলেন পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯৪৯ সালে মজলিশের সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যাই বেশি এবং তারা বাঙালি, সেহেতু অবশ্যই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল কার্যাবলীর জন্য ব্যবহার করা উচিত এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। কিন্তু লিয়াকত আলী খান সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের ভিত্তিতে এই দাবী নাকচ করে দেন।

১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ "স্টুডেন্টস রোল ইন নেশন বিল্ডিং" শিরোনামে একটি ভাষণ প্রদান করেন। ক্যাটেগরিক্যালী বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার দাবীকে নাকচ করে দিয়ে  ২৪ শে মার্চ, ১৯৪৮-এ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন  "পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি উর্দু, একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয়কে তুলে ধরে।

এরপরে ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের সংবিধান পরিষদ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সুপারিশ পেশ করে, যা পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষোভের প্রবাহ ছড়িয়ে দেয় এবং বিক্ষোভ শুরু হয়। পুলিশ জনতার উপর গুলি চালায়, ফলে ২৬ জন মারা যায় এবং শত শত আহত হয়। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভাযাত্রাসহকারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং এক কিশোর। শহরজুড়ে দাঙ্গা এবং স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং লোকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হামলার দিন সন্ধ্যায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী এই প্রতিবাদে নিহতদের প্রবেশদ্বারটিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। স্থাপনের পর পরই পুলিশ সেটিকে গুড়িয়ে দেয়।

জাতীয় পর্যায়ে, ‘ভাষা আন্দোলন’ এর প্রভাব স্বাধীনতার জন্য বৃহত্তর প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। পশ্চিম পাকিস্তান দেশের উভয় অংশের অপ্রতিরোধ্য মুসলিম পরিচয়কে পুঁজি করার চেষ্টা করেছিল এবং ভাষাকে উর্দু ভাষাগতভাবে আরবি ও ফার্সির সাথে সম্পর্কিত বলে যুক্তি দিয়ে ইসলামিক সংস্কৃতিকে সর্বোচ্চ উপস্থাপন করেছিল। এমনকি এটি ভাষা দ্বন্দ্বকে আরও তীব্র করে বাঙ্গালীকে "সংস্কার" করার পরামর্শ দেয়। এটি এও পুরোপুরি স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে ধর্মীয় সাধারণতার উপর পূর্বানুমিত পাকিস্তানের জাতীয় পরিচয়ের জন্য অপর্যাপ্ত ছিল।ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করে। এর কাজ শেষ হয় ২৪ তারিখ ভোরে।

সেসময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিল ভাষা সংগ্রামী রফিকের লাশ। লাশটি দেখে তার মনে হয়, এটা যেন তার নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তৎক্ষণাৎ তার মনে গানের প্রথম দুটি লাইন জেগে উঠে। পরে কয়েকদিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লিখেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি 'একুশের গান' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। 

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা পেয়েছি মায়ের ভাষা। বাংলাদেশে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবস পালন করা হয়। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি গেয়ে প্রতি বছর তাদের স্মরণ করি আমরা। ৬৯ বছর আগে যারা বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন, সেই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রভাতফেরির গান গেয়ে সবাই শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। 

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন