শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী...

আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৩:১৫

২০১৬ সালের কথা। একুশের ফাল্গুনি উদ্যাপনের রেশ চলছে তখনো। ঢাকার ধানমন্ডিতে প্রাক্তন সাংসদ, কবি আই ভি রাহমানের বাসভবনে এক বিদেশি মেহমানের জন্মদিনকে ঘিরে সান্ধ্য আড্ডায় জড়ো হয়েছেন কয়েক জন কবি, লেখক, গায়ক আর আবৃত্তিকার। কথা ছুটছে নানা দিকে। নানা বিষয় নিয়ে। বাঙালির আড্ডায় যেরকম হয়ে থাকে, নির্দিষ্ট বিষয় নেই—মৃদু তর্ক, স্মৃতিচারণ, ইতিহাস, কবিতা, গান—সবই ছুঁয়ে যাচ্ছেন প্রত্যেকে। 

ভাষা আন্দোলন, বাঙালিরে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির খেদও উঠে আসছে। কোনো একজন কথা প্রসঙ্গে ছুড়ে দিলেন একটি তির্যক প্রশ্ন—প্রথম ভাষাযোদ্ধা কে? ঐ জনৈক নিজেই জবাব দিলেন—কবি আব্দুল হাকিম। বলেই তার মন্তব্য—আব্দুল হাকিমকে মরণোত্তর মর্যাদা দিতে হবে একুশের পদক অর্পণ করে, তার স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তুলে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলল কিছুক্ষণ। আড্ডায় হাজির এই খুচরো কলমচি সেদিন নিঃশব্দ শ্রোতামাত্র। 

তর্কে যার অনীহা প্রশ্নাতীত, যে বিশ্বাস করে অতিতর্ক যুক্তিকে আচ্ছন্ন করে দেয়। হ্যাঁ তর্কের সঙ্গে প্রশ্ন যখন জেগে ওঠে, তখন বোধ আর বোধি সিদ্ধান্তের দিকে এগোতে থাকে। সেদিনের আড্ডায় আব্দুল হাকিমের প্রসঙ্গ ঠিক এইভাবে স্পর্শ করে আমাকে। প্রশ্ন জাগাল, কেন সতেরো শতকের সুফি ঘরানার কবিকে (১৬২০-১৬৯০) আক্ষেপ করে বলতে হয়েছিল—‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী---দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জোয়ায়, নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশে ন যায়!’

সামাজিক আর সাহিত্যিক পরিসর কি তখন বিরুদ্ধ ছিল? পর্তুগিজ শাসনাধীন বৃহত্তম চট্টগ্রামে বাংলা ভাষার চর্চায় অন্তরায় দেখা দিচ্ছিল? ইসলামি বাংলা প্রচলনের মানসিক দাবির প্রয়োগ কি বেজে উঠছিল কোনো কোনো স্তরে? কেন আব্দুল হাকিমের আগে তারই একজন পূর্বসূরিকে বলতে শোনা গিয়েছিল—‘লিখিনু আমি হিন্দুয়ালি ভাষায়?’ বাঙালির বড় অংশ কি সে সময় বাংলা ভাষাকে হিন্দুর ভাষা ভাবত? গণমানসে সক্রিয় ছিল বুঝি এমন কোনো দ্বন্দ্ব, যা তার জাতিচেতনাকে খণ্ডিত করে বহির্দেশ, বহির্ভাষার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল? 

এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের সামাজিক ইতিহাস খোঁজেনি, তা নয়। খুঁজেছেন শানিতবুদ্ধির ইতিহাস বেত্তারা, কিন্তু সন্ধান অসম্পূর্ণ হয়ে রইল আজও। বাংলা ভাষার চর্চা ও ব্যাবহারিক বাস্তবতা নিষ্কণ্টক ছিল না কখনো। শত শত বছরব্যাপী বাঙালির সুবুদ্ধিকে রাষ্ট্র, শাসকের বিভ্রান্ত সামাজিকতা আর প্রাগ্রসরের জনবিচ্ছিন্ন ভাষা চিন্তার বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। জাতির অখণ্ড সত্তাকে কখনো শ্রেণি, কখনো ধর্মীয় ভেদরেখায় আটকে রাখতে চেয়েছে যারা—জাতিকে মানুষ ভাবেনি, বাঙালি ভাবেনি, ভেবেছে নিছক একটি সাম্প্রদায়িক জীব—তাদের জন্মের নির্ণয় নিয়ে প্রথম তীক্ষ প্রশ্ন তুলেছিলেন আব্দুল হাকিম। সে অর্থে তিনিই প্রথম ঘোষিত ভাষাযোদ্ধা। তাকে আমরা কতটা মনে রেখেছি, কতটা মর্যাদা দিয়েছি সামাজিক অঙ্গনে, আমাদের ভাষাযুদ্ধের ইতিবৃত্তে তার বৃত্তান্ত কতটা বিস্তৃত, আলোচিত, তর্কের নয় তা, প্রভূত জিজ্ঞাসার বিষয়।

আব্দুল হাকিমের মৃত্যুর (১৬৯০) ২৬২ বছর পর ঢাকায় এবং আরো এক দশক পরে আসামের শিলচরে বাঙালির তারুণ্য আত্মাহুতি দিয়ে প্রমাণ করল যে, ভাষাকে, আবহমান সংস্কৃতিকে জড়িয়ে তারা যেমন পরিপূর্ণ বাঙালি, তেমনি বিশ্বমানব হতে চাইছে। শ্রেণি আর সম্প্রদায়ের আরোপিত সীমা পেরিয়ে তাদের আকাঙ্ক্ষা আদায় করে নেয় গণসম্মতি। কবি আব্দুল হাকিমের স্বপ্ন পূর্ববঙ্গে অংশত পূর্ণ হলো মহান একুশের গণজাগরণে, আসামের বরাক উপত্যকায় উনিশে মে-র একাদশ শহিদের দুঃসাহসী আত্মদানে।

দুটি ঘটনাই বাঙালির ইতিহাসের ‘মহোত্তম কিংবদন্তি’। পূর্ববঙ্গ তার শত শত বছরের সংশয় কাটিয়ে বাঙালি হয়ে উঠল। স্পষ্ট ভাষায় নির্ণীত হলো তার সামাজিক, রাজনীতিক ও সংস্কৃতিক সংজ্ঞা। ঢেউ লাগল সমগ্র চেতনায়। বাংলা ভাষার শরীর থেকে ’৫২-র একুশে যে রক্ত বেরোল, তা গণবিপ্লব আর স্বাধীনতার উন্মেষিত আকাঙ্ক্ষার প্রকাশক হয়ে গেল। সেদিনই ওখানকার সাধারণ থেকে অসাধারণ সবাই বুঝতে পারল যে, বাঙালি একটি অখণ্ড জাতি। শ্রেণি-আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা, সাম্প্রদায়িক ক্ষুদ্রতা, আঞ্চলিক মূঢ়তা পেরিয়ে সে নতুন উত্তরণ দাবি করছে। দাবিটি যুক্ত সূচিত, বিবেকপ্রসূত। 

শোষণ যত বাড়ল, ততই সে উদ্দাম হতে থাকল দুই দশকের লাতাগার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কালের অপ্রতিরোধ্য প্রহরীর মতো দিকদর্শী বঙ্গবন্ধুকেও সামনে পেয়ে গেল, যার ত্যাগ আর সমতার দর্শন পূর্ববঙ্গের বাঙালিকে অধিকতর দুঃসাহসী করে তুলে উপমহাদেশের প্রথম জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নকে সম্ভাবনাময় বাস্তব বানিয়ে দিল। বাঙালির ইতিহাসে এটি আরেক মহত্ ঘটনা। ’৫২-র একুশ তার সূচনাগৃহ আর একাত্তরের ২৫শে মার্চ এর বাধ্যতামূলক বাস্তবতাবোধের মরণপণ বিস্তার। ‘একুশকে একরঙা চেতনা দিয়ে নির্দেশ করা অসম্ভব। সে বহু রঙে রাঙা আর বহুমুখী।’ বলেছিলেন বহুমাত্রিক জাদুকর হুমায়ুন আজাদ। 

বলা বাহুল্য, একুশের আগুন থেকে, সে অগ্নিশিখা থেকে অন্যরকম বিপ্লবের পাঠ নিয়েছিল তারুণ্য? কী রকম বিপ্লব সেটা? তা কি কেবল পূর্ববঙ্গের ভৌগোলিক অযতনে সীমাবদ্ধ! অবশ্যই নয়। একটি সমবেত আর সমগোত্রীয় জাতি প্রকাশ্যে বলতে শুরু করল—আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের শেকড়, আমাদের ডালপালার বিস্তারের লক্ষ্য ঘাতক আর শোষকের ক্ষমতামত্ততা এবং বহুত্ববোধই তার উত্স। এই বার্তা সে ছড়িয়ে দিল বিশ্বে, পরে যা স্বীকৃতি পেল আন্তর্জাতিক মঞ্চে। এ স্বীকৃতি শুধু বাংলা ভাষার নয়, প্রথিবীর প্রতিটি অবদমিত জাতি ও তাদের মাতৃভাষার। এ কারণেই মহান একুশ আমাদের মহোত্ত্তম অর্জন। এ অর্জিত রত্নের অংশীদার আজ সব দেশ। সব জাতি।

বাঙালির সৌভাগ্য, সে ক্ষমতার ভাষা আর ক্ষমতামত্ততার মোকাবিলায় তার লড়াইকে অংশত আয়ত্তে নিয়ে এসেছে। সে ভাগ্যবান, তার মাতৃভাষা আজ আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির অন্যতম রূপকার হয়ে উঠছে। রবীন্দ্রনাথ অন্তরের যে শক্তিকে এক মানবের সাধনা বলেছিলেন, যে সাধানার শরিক হয়ে আছেন আমাদের আউল-বাউল, আমাদের বোধির সব আশ্রয় আর গণদেবতারা— তাদেরই বোধিবৃক্ষ, বর্ণমালাকে স্পর্শ করে তার বিস্তারিত ছত্রছায়ায় আজ সে-সাধনায় একত্রিত হতে চাইছে সংকটাপন্ন দুনিয়া। অতএব, বাঙালির অর্জিত আর উপার্জিত এ গৌরব বড় বেশি অমূল্য। এজন্য কালের বিচারে একুশের আত্মত্যাগ কিংবদন্তিই হয়ে থাকবে। এ গৌরবকে, গৌরবের উত্স বঙ্গবাণীকে যে হিংসে করে, হেয় করে, তার আত্মঘাতী চিন্তার মূলচ্ছেদ অপরিহার্য এবং অবশ্যম্ভাবী।

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন