শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

তারুণ্য ও একুশের চেতনা

আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৩:৫২

২১শে ফেব্রুয়ারি এলেই বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক ভিন্ন আবহের সৃষ্টি হয়। স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে বাঙালির অতীত গৌরবময় সংগ্রামের। যে সংগ্রামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিক মুক্তি ও নিজেদের সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর রাষ্ট্রের নীতি ও আদর্শ নিয়ে জনমনে বিভ্রান্ত দেখা যায়। 

উগ্রতা, ধর্মীয় অন্ধতা ও সংকীর্ণতার বশবর্তী হয়ে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে তত্কালীন পূর্বপাকিস্তানকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শুরু করে বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার মহাকৌশল। যার মূলমন্ত্রই ছিল অত্যাচার, অনাচার, বঞ্চনা, বৈষম্য ও নিপীড়ন। আর এই রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও দমননীতি অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, গড়িয়েছে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র পর্যন্ত।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী প্রথমেই বাঙালিকে সাংস্কৃতিক ভাবে কোণঠাসা করতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছিল। একটু দেরিতে হলেও বাঙালি উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, তাদের ভাব প্রকাশের মাধ্যম মাতৃভাষাকে পরিবর্তন করার নীলনকশা প্রণয়ন করা হচ্ছে; কিন্তু লড়াকু মানসিকতার অধিকারী বাঙালি থেমে থাকেনি। তারা অধিকার আদায়ের দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে। তর্জন-গর্জন আর হুংকারে প্রকম্পিত করেছে রাজপথ। এ কাজে হাল ধরেছিল রাজনীতিসচেতন ছাত্রসমাজ, শিক্ষিতশ্রেণির বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ নন। বৃহত্তর পরিসরে আন্দোলন শুরু হলে তারা অবশ্য সমর্থন জানাতে এগিয়ে আসেন। শাসকশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত নন, বিশেষ সুবিধাভোগে বঞ্চিত এমন রাজনীতিকরাও ছাত্রসমাজের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন; কিন্তু মূল ক্রীড়নকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তত্কালীন ছাত্রসমাজের এক বৃহত্ অংশ।

আজ থেকে অর্ধশতকেরও বেশি সময় আগে তারুণ্যের অদম্য সঞ্জীবনী শক্তিতে উজ্জীবিত হয়েই তত্কালীন মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণেরা মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দিয়ে নিজেদের স্বকীয়তা ও স্বাজাত্যবোধের মশাল জ্বালিয়ে প্রজ্বলিত করেছিলেন পুরা জাতিগোষ্ঠীকে।

একুশ আমাদের শাশ্বত এক আলোকভান্ডার। যা সর্বস্তরের উন্নতি, অগ্রগতি ও এগিয়ে যাওয়ার সাহস যোগায়। যা নিয়ে আসে মুক্তির বারতা। যার জলজ্যান্ত প্রমাণ একুশ-পরবর্তী জাতীয় মুক্তির সমস্ত সংগ্রাম। সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, মাতৃভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন ও জনগণের ম্যান্ডেট, ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও অসহযোগ আন্দোলন, স্বাধীনতার ঘোষণা—এ সবই একুশে চেতনার ফল।

নিঃসন্দেহে একুশ আমাদের শতসহস্র চেতনা ও প্রেরণার উত্স; কিন্তু সমসাময়িক সমাজ স্বরূপের দিকে তাকালে যে কারোরই মনে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে যে—অর্ধশতকেরও বেশি সময় আগে আমাদের পূর্ববর্তী মৃত্যুঞ্জয়ী প্রজন্ম একুশের যে চেতনা আমাদের দিয়ে গিয়েছিল তা আমরা জনমনে কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি?

যেসব তরুণ একসময় মা, মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে মুক্তিসংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিল তাদের উত্তরসূরি বর্তমান প্রজন্ম আজ কিশোর গ্যাং, সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার ও বিদেশি অপকালচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা আজকে নিজের সংস্কৃতির চেয়ে বিদেশি অপসংস্কৃতি ও আকাশ সংস্কৃতিকে অতিমাত্রায় গ্রহণ করছে। ফলস্বরূপ সমাজে সামাজিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সমাজ এগিয়ে চলছে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে। যেখানে একুশের চেতনা ও মূল্যবোধ ভয়ানক রূপে মুহ্যমান।

প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে ও বিশ্ব নাগরিকের যোগ্যতা অর্জনে অবশ্যই বিদেশি সংস্কৃতিকে আমাদের জানার প্রয়োজন আছে; কিন্তু তা কখনোই নিজের মূল বা শিকড়কে উপেক্ষা করে নয়। কারণ, শিকড়ের প্রতি ভালোবাসার আরেক নামই দেশপ্রেম তথা আমাদের ভাষাশহিদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা অর্পণের সর্বোত্তম পন্থা।

একুশের চেতনাকে উপজীব্য মনে করে আমাদের যে প্রত্যাশা ছিল সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে তাতে প্রাপ্তির অঙ্ক অনেক কম! অতএব, এই প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, তবে কি আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে একুশের চেতনা ও মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা শেষ? এক কথায় উত্তর, না। 

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমরা যখনই পথ হারিয়ে অনিশ্চয়তার পানে হেঁটে চলেছি—তখনই একুশ আমাদের পথ দেখিয়েছে। যুগিয়েছে প্রাপ্তির প্রত্যাশা ও প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সাহস। তাই অসহিষ্ণুতা ও সন্ত্রাসের চোরাবালিকে বিনাশ করতে একুশের চেতনাকে ক্ষণে নয়, মনে ধারণ করতে হবে। তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে। তবে আসবে মুক্তি, সমৃদ্ধি ও প্রগতি। তখন দ্বিধাহীন চিত্তে তারুণ্যের গৌরবে গৌরবান্বিত হয়ে বলতে পারবো—তারুণ্য দেবে নেতৃত্ব, তারুণ্য দেখাবে যুক্তি, তারুণ্য নিয়ে আসবে মুক্তি।

ইত্তেফাক/এএইচপি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন