শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ

আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২১, ১৩:৪৮

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন অনেকেই দেশটিকে "A test case for Development" বলে অভিহিত করেছিলেন [দেখুন Just Faaland and Jack R. Parkinsons (1976), "Bangladesh The test case for Development", London C. Hust and Co, 203 pp]। এই অভিধার তাৎপর্যটি ছিল বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দেওয়া উন্নত দেশের একটি চ্যালেঞ্জের মতো। যারা তখন এটা বলতেন তারা ভাবতেন যে, বাংলাদেশে উন্নয়নের পথে এমন কতকগুলো বাধা রয়েছে, যা ডিঙিয়ে বাংলাদেশের উন্নত হওয়াটা হবে অসম্ভব একটি ব্যাপার।

প্রথমত, বাংলাদেশে তখন লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৭ কোটি আর দেশটির আয়তন ছিল মাত্র ৫৪ হাজার বর্গমাইল। এত অল্প জায়গায় এত বেশি লোক পৃথিবীতে তখন খুব একটা ছিল না। তখনো বাংলাদেশ জনসংখ্যা/বর্গমিটার বিচারে নবম বা দশম হবে। তা ছাড়া ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত দেশটির ওপর একধরনের আধা ঔপনেবিশিক শোষণ (Semi Colonial Exploitation) চালানো হয়েছিল। ফলে দেশের ভেতরে শিল্পায়নের মাত্রা ছিল কম। অবকাঠামো ছিল দুর্বল, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছিল অবিকশিত। এসব উন্নতির ছিটেফোঁটা যেটুকু ছিল তার সবটাই প্রায় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের দখলে। সারা পাকিস্তানে তখন ব্যাংক-বিমা, শিল্প-কারখানা ইত্যাদি সম্পদের সিংহভাগ ছিল ২২টি পরিবারের দখলে এবং তাদের মধ্যে একটি পরিবার ছিল বাঙালি (এ কে খানের পরিবার)।

এছাড়া প্রশাসনযন্ত্রে, আর্মিতে রাজনৈতিক বিভিন্ন উচ্চপদে—সর্বত্র ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রাধান্য। সুতরাং পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত আধা-ঔপনিবেশিক শোষণ-নির্যাতন-বৈষম্যের শিকার একটি প্রদেশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম প্রতিবাদের রব ওঠে ১৯৫২ সালে, পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র পাঁচ বছর পর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এর পরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ছয় দফা স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, ১১ দফা জনগণের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ। এসব সংগ্রামের মূলে ছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা।

১৯৭১ সালে ৯ মাস এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জিত হলো ঠিকই, কিন্তু দেশের সারা অঙ্গে রয়ে গেল ঔপনিবেশিক শোষণের ক্ষতচিহ্ন। পাকিস্তানিরা মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘পোড়া মাটির নীতি’ (Scorched Earth Operation) অনুসরণ করেছিল। অর্থাত্ তারা ভেবেছিল, তারা যদি পরাজিত হয়ে এ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়, তাহলে তারা যাওয়ার আগে সব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে যাবে। আর এই নীতি তারা অক্ষরে অক্ষরে কার্যকর করেছিল। প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে, ১ কোটি লোককে উদ্বাস্তুতে পরিণত করে, ফসল ও কারখানা ধ্বংস করে দিয়ে, সমস্ত যোগাযোগব্যবস্থা লন্ডভন্ড করে দেয় তারা।

সবাই ভেবেছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে দুই দিনও টিকতে পারবে না। দেশে দুর্ভিক্ষ হবে। অর্থনীতি আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না। পাকিস্তানিরাও তাই আশা করেছিল এবং তাই পরাজয়ের পূর্বমুহূর্তে তারা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের রাও ফরমান আলী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে গঠিত বদর বাহিনীর নীল নকশা অনুযায়ী হত্যা করে যায়। তারা ভেবেছিল, সেভাবেই বাংলাদেশকে তারা নেতৃত্বশূন্য করে দিতে পারবে এবং বাংলাদেশ স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাবে। আর এসব বাস্তব পাহাড়সম অসুবিধা ও চ্যালেঞ্জগুলোর জন্যই অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিত তখন বলেছিলেন যে, এতত্সত্ত্বেও যদি বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াতে পারে, উন্নত দেশে পরিণত হতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে যে পৃথিবীর যে কোনো অনুন্নত দেশই একদিন না একদিন উন্নত হতে পারবে।

আজ শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাবি করতে পারে যে বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যায়নি, মাথা তুলে সে বিশ্বের মাঝে বুক ফুলিয়ে উন্নত দেশ হওয়ার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের অর্জনসমূহ

এখন পৃথিবীতে যে ১১টি দেশকে ভবিষ্যত্ উন্নয়নের জন্য ‘উদীয়মান এগারো’ (Emerging Eleven) বলে অভিহিত করা হয়, তাদের মধ্যে আমরা একটি দেশ হিসাবে বিরাজ করছি। আমরা গত কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের আশপাশে ধরে রেখেছি। আমাদের দেশে দারিদ্র্যের হার ১৯৭৪ সালে ছিল ৭৫ শতাংশ। (অর্থাত্ শতকরা ৭৫টি পরিবারেরই বেঁচে থাকার মতো খাবার কেনার সামর্থ্য ছিল না) আজ সেই হার ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। যদিও করোনার কারণে তা আবার কিছুটা বেড়ে গিয়ে থাকতে পারে (কারো কারো মতে দ্বিগুণ হয়ে গেছে)। আমরা ১৯৭১ সালে ছিলাম কৃষিপ্রধান দেশ। আজ জিডিপিতে কৃষির অবদান মাত্র ১৩ শতাংশ, শিল্পের ৩০ শতাংশ এবং সেবা খাতের অবদান ৫৭ শতাংশ। আমরা আজ কাঠামোগতভাবে আধুনিক শিল্পায়িত দেশে পরিণত হতে চলেছি। কিন্তু প্রায় ১৬ কোটি লোককে আজ আমাদের কৃষকেরা কম জমিতে দ্বিগুণ-ত্রিগুণ উত্পাদন বৃদ্ধি করে খাইয়ে-পরিয়ে রেখেছেন—এটা মোটেও কম কোনো অর্জন নয়!

আমাদের দেশে লক্ষণীয়ভাবে নারীরা কাজে-কর্মে এগিয়ে এসেছেন এবং তার ফলে অনেক পরিবারেই এখন দুজন উপার্জনকারী সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দারিদ্র্যের চাপও অনেক কমেছে। আমাদের দেশে প্রায় শতভাগ শিশু এখন প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

শিশু মৃত্যুর হার, মাতৃ মৃত্যুর হার, গড় আয়ুষ্কাল ইত্যাদি মানব উন্নয়ন সূচকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ প্রতিবেশী দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন স্বয়ং এ কথা আজ বলছেন।

আমাদের পোশাকশিল্প, ওষুধশিল্প, সিমেন্ট শিল্প, মাছ, সবজি, ফুল ইত্যাদি পণ্য সারা দুনিয়ায় এখন রপ্তানি হচ্ছে।

আমাদের দেশের বিদেশে কর্মরত নাগরিকেরা যে রেমিট্যান্স প্রতি বছর পাঠান, তা দিয়ে আমরা আমাদের বিশাল বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার গড়ে তুলেছি। বিদেশিরা অর্থসাহায্য না দিলেও আমরা এখন নিজেদের টাকাতেই নিজেদের পদ্মা ব্রিজসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে সক্ষম। আমাদের তথাকথিত ‘বিদেশি দাতা দেশগুলো’ (Foreign Donor Countries) আজ আর পরিহাস করে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ (Bottomless Basket) আখ্যা দিতে পারে না।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ২০১৫ সালের এমডিজির (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল) অধিকাংশ লক্ষ্য অর্জনসহ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের শ্রেণিভুক্ত হয়েছে। যষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজনীয় সব মানদণ্ড পূরণ করতে পেরেছে। ফলে বাংলাদেশ যে একদিন মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হবে, সে কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জসমূহ

কিন্তু মধ্য আয়ের দেশে কোনো দুর্ঘটনা ছাড়া উত্তরণ ঘটাতে হলে আমাদের দুটো গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ করতে হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তি। সেই উদ্দেশ্যেই ৫০ বছর আগে বাইরের শোষণ-বৈষম্য-নির্যাতন থেকে আমরা প্রথমে স্বাধীন হয়েছিলাম, আজ দেশের ভেতরের শোষণ-বৈষম্য-নির্যাতন থেকে আমাদের জনগণকে মুক্ত করতে হবে। ৩০ লাখ শহিদের স্বপ্নও তা-ই ছিল। তাই রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক অধিকার উভয়ই আমাদের অর্জন করতে হবে। যদিও এ দুটো লক্ষ্য একসঙ্গে অর্জন ঐতিহাসিকভাবে খুবই কঠিন একটি কাজ। আমাদের এ কাজ সমাপন করার জন্য হতে হবে গুহার ভেতরে আহত রাজা রবার্ট ব্রুসের দেখা সেই মাকড়সার মতো, যে জাল বেয়ে শত বার পড়ে যাওয়ার পরেও শত বার ওপরে ওঠার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল।

বঙ্গবন্ধুও দুঃখী মানুষের মুক্তির জন্য দারিদ্র্য-ক্ষুধামুক্ত শোষণহীন-সমাজতান্ত্রিক-গণতান্ত্রিক দেশের মহত্ স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা তার আত্মজীবনীতে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনি ভাষণে, তার স্বহস্তে স্বাক্ষরিত ১৯৭২ সালের সংবিধানে এবং স্বাধীনতা উত্তর নানা বক্তব্য, বিবৃতিতে নানাভাবে বিধৃত আছে। কিন্তু তার মৃত্যুর আগেই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও খন্দকার মুশতাকের ছত্রছায়ায় দক্ষিণপন্থিরা ও নব্য ধনীরা (Nouveau Rich) শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং সপরিবারে তার মর্মান্তিক ও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর এই গোষ্ঠীই সবকিছুর অন্যতম Beneficiar-তে রূপান্তরিত হয়। এ কথাও সত্য, বঙ্গবন্ধুও তার দলীয় শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতার জন্য সমাজতন্ত্রের দিকে দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হতে পারেননি। বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করে শেষ মুহূর্তে তিনি তার মতো করে একটি শেষ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তা আঁতুড়ঘরেই মৃত্যুবরণ করে। বঙ্গবন্ধু শাহাদত বরণ না করে বেঁচে থাকলে কী হতো বা হতে পারত, সেই আলোচনা আজ বৃথা এবং নিতান্তই একটি অনুমানমূলক অমীমাংসেয় Hypothetical আলোচনা।

কিন্তু স্বাধীনতার ঊষালগ্নে দেখা বঙ্গবন্ধুর দারিদ্র্যমুক্ত-ক্ষুধামুক্ত-শোষণহীন-সমাজতান্ত্রিক-গণতান্ত্রিক দেশের মহত্ স্বপ্নটি তার দল আজ মূলত ছেড়ে দিলেও সাধারণ মানুষ দেশবাসী জনগণ এবং তার দলের ভেতরে ও বাইরে এখনো থেকে যাওয়া তার লাখ লাখ অনুসারী ভক্ত নিশ্চয়ই আজো সেই স্বপ্ন ছাড়েননি। সেই স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের সঠিক পথটি না বের করা পর্যন্ত সব শহিদের প্রতি আমাদের ঋণ পূর্ণভাবে পরিশোধিত হবে না। আসুন, স্বীয় কর্তব্য সমাপ্ত করার জন্য ব্রুসের মতো অধ্যবসায় ও মনোযোগ দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আবার আমরা সেই ‘হারানো সিঁড়ির চাবিটি’ খুঁজে বার করি। আমরা শহিদদের প্রতি আমাদের ঋণ পরিশোধ করি। বিশ্বের বুকে আমাদের প্রিয় স্বদেশ শোষণহীন-লুণ্ঠনহীন-দুর্নীতিহীন গণতান্ত্রিক উন্নত স্বচ্ছ এক দেশ হিসেবে আবার মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়াক।

লেখক: চেয়ারম্যান, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়