বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশ

আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২১, ১৩:৪৯

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটল বাংলাদেশের। ২০১৮ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো এবং ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্তভাবে এই সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ। ফলে বাংলাদেশের এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ভোগ করতে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা রইল না।

মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিন সূচকে বিচার করা হয় একটি দেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল ধাপে উত্তরণ করবে কি না। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে হলে অন্তত দুটি সূচক পূরণ করতে হয় একটি দেশকে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম দেশ হিসেবে তিনটি সূচকের সব কটি পূরণ করে পরবর্তী ধাপে উন্নীত হয়েছে। চলতি ২০২১ সালে এক দফা পর্যবেক্ষণের পর ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে বাংলাদেশ।

২০১৪ সালের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল কর্তৃক প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক রিপোর্টে উন্নয়নশীল দেশসমূহের তালিকায় বাংলাদেশের নাম প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয়। বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জুলাইয়ে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। এখন জাতিসংঘের মাপকাঠিতেও বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটল। জাতিসংঘ তার সদস্যদেশগুলোকে স্বল্পোন্নত (এলডিসি), উন্নয়নশীল ও উন্নত—এই তিন পর্যায়ে বিবেচনা করে।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল (ইকোসক)-এর মানদণ্ড অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশ হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হয় কমপক্ষে ১ হাজার ২৩০ মার্কিন ডলার, জাতিসংঘের হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ২৭৪ ডলার। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবমতে, মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৬১০ ডলার।

ইকোসকের মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে ৬৪ পয়েন্টের প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশের আছে ৭২। অর্থনৈতিক ঝুঁকির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫ দশমিক ২। এই পয়েন্ট ৩৬-এর বেশি হলে এলডিসিভুক্ত হয়, ৩২-এ এলে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জিত হয়।

বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদাপ্রাপ্তি উপলক্ষ্যে গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন আমার বয়স ৭৫ বছর, ২০৪১-এ হবে ৯৫। তখন আমি নিশ্চয় ক্ষমতায় থাকব না, হয়তো বেঁচেও থাকব না। কিন্তু আগামী ২০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ যাতে উন্নত দেশে পরিণত হতে পারে, তার জন্য বিস্তারিত পরিকল্পনা ও কর্মসূচি আমি রেখে যাচ্ছি। ’

বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল হয়ে উন্নত দেশে পরিণত করার দুরারোহ পথের অভিযাত্রী প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা তার বাবা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেখে যাওয়া স্বপ্নাদর্শের আলোকে এগিয়ে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য দূরদর্শী নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে উন্নীত হতে পেরেছে। একসময় দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষে জর্জরিত বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের নবতর অভিযাত্রায় এগিয়ে চলেছে।

বাংলাদেশের দ্রুত উন্নয়নের দিকে একঝলক দৃষ্টিপাত করা যাক। এ সরকার টানা দশকাধিক কাল ধরে ক্ষমতাসীন থাকাকালে দেশে দারিদ্র্যের হার বিস্ময়করভাবে হ্রাস পেয়েছে। অতিদারিদ্র্যের হার কমেছে। নব্বইয়ের দশকে যেখানে বাংলাদেশে মাত্র ২৩ লাখ লোক দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করতে পেরেছিল, সেখানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের জনমুখী পদক্ষেপের ফলে গত ৯ বছরে ৫ কোটি মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার ছিল ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ। বর্তমানে ২১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে এসেছে এবং হতদরিদ্রের হার ২৪ দশমিক ২ থেকে ১১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। বিএনপি আমলে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫৪৩ ডলার, আর আজ তা ১ হাজার ৭৫২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

বিনা মূল্যে শিক্ষা ও চিকিত্সা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ৯ বছরে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে সর্বমোট প্রায় ২৬০ কোটি ৮৫ লাখ ৯১ হাজার ২৮০টি বই বিতরণ করা হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। বিনা মূল্যে ৩০ ধরণের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতেও বইতে শুরু করেছে পরিবর্তনের হাওয়া। প্রতিনিয়ত পালটে যাচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চেহারা। খাদ্য ঘাটতি থেকে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হচ্ছে দেশ।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উেক্ষপণ, পোশাকশিল্প, ওষুধশিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়িত হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুকন্যার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছে, যার ফলে গত এক যুগে বদলে গেছে মানুষের জীবনমান। এরই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মর্যাদা দিল। বিগত ১২ বছরে সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যত অর্জন হয়েছে, তার সবগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম।

আশঙ্কা করা হয়েছিল, করোনা পরিস্থিতিতে দেশে হাজার হাজার মানুষ অনাহারে মারা যাবে। কিন্তু সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের কারণে গত এক বছরে একজন মানুষও অনাহারে মারা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সব সময় মানুষের পাশে ছিলেন, যার ফলে সরকারের মন্ত্রী, এমপিসহ কয়েক হাজার নেতাকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়ায় বাংলাদেশের সামনে যেমন নতুন সম্ভাবনা ও সুযোগ তৈরি হবে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে ভাবমূর্তি উন্নয়নের ফলে বৈদেশিক ঋণ পাওয়া সুবিধাজনক হতে পারে। একটি দেশে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ার সুযোগ তৈরি হয়ে থাকে। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ মসৃণ ও টেকসই করতে দেশের অভ্যন্তরীণ সুশাসন ও স্থিতিশীলতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেটি আজ প্রায় এক যুগ ধরে আমাদের দিয়ে চলেছে বর্তমান সরকার।

 লেখক :ইংরেজির অধ্যাপক এবং সাবেক উপ-উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

ইত্তেফাক/এআর