বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় ভারত ও বাংলাদেশের অর্থনীতি  

আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২১, ১২:৫৩

ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক শিকড় তো রয়েইছে, রয়েছে অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতাও। ভূ-কৌশলগত কারণেও ভারত ও বাংলাদেশ একে অন্যের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্কের ভিত অতি গভীরে। গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও সম্পর্ককে আরও উন্নত করেছে দুই প্রতিবেশী। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার আর ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের নতুন দিশা দেখিয়েছে। বহু পুরনো সমস্যাকে সমাধান করতে সমর্থ হয়েছে তারা। সব বাধাবিপত্তি কাটিয়ে এখন দু-দেশই সাধারণ মানুষের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছে। 

নিজেদের মধ্যে প্রচুর মিল রয়েছে। তবু ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব এতোটা গভীরে কখনও প্রবেশ করেনি।  মুক্তিযুদ্ধের সময় নতুন প্রত্যাশা তৈরি হলেও সেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উভয় পক্ষের আস্থা অর্জনে আগে ততোটা সফল হয়নি। কিন্তু এখন উভয় দেশের সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো ও কার্যকরী। অর্থনৈতিক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে উভয় দেশ এখন একসঙ্গে কাজ করছে। ২০১৪ সালে মোদি সরকার ভারতে ক্ষমতায় আসার পর তার 'লুক-ইস্ট' পলিসি বা পূবে তাকাও নীতি পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির নতুন দিশা দেখায়। মোদি ক্ষমতায় আসতেই সেই বছরেই বাংলাদেশের সঙ্গে সামুদ্রিক সীমানা বিবাদ ও পরের বছর স্থল সীমান্ত বিবাদ মিটিয়ে নিতে সক্ষম হয় ভারত। 

চলতি বছরে ভারত ও বাংলাদেশ পালন করছে কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী। একইসঙ্গে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেরও ৫০ বছর। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে স্মরণীয় করে রাখতে ভারতও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। চলতি মাসেই মোদি ঢাকা সফরে আসছেন। এর আগে, ১৭ ডিসেম্বর দু-দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব ভার্চুয়াল বৈঠকে অংশ নেন। মোদি দক্ষিণ এশিয় দেশগুলিকে নিজের কাজের মধ্যে দিয়েও বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভারতের নীতিই হলো প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্বকে অগ্রাধিকার। 

আন্তর্দেশীয় যোগাযোগের ক্ষেত্র গত কয়েক বছরে অনেকটাই প্রসারিত হয়েছে। অনেক পরিবহণ করিডোর খুলতে সক্ষম হয়েছে উভয় দেশ। রেল, বাস ও নৌ পরিবহণ যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন দিশা দেখাচ্ছে। ২০১৮ সালে পেট্রাপোল-বেনাপোল দিয়ে চালু হয়েছে বন্ধন এক্সপ্রেস। ৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে ভৈরব সেতু ও ২৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করে বাংলাদেশের তিতাস সেতু নির্মাণেও ভারত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। চলতি বছরেই সীমান্তে ৯ মার্চ ফেনী নদীর ওপর ১ দশমিক ৯ কিমি মৈত্রী সেতু উদ্বোধন হয়েছে। ভিডিও বার্তায় প্রধানমন্ত্রী হাসিনা মৈত্রী সেতুর উদ্বোধনকে ঐতিহাসিক বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘ভারতের এই অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বাংলাদেশের সদিচ্ছা ও সহয়োগিতার পরিচায়ক এই সেতু। সেতুটি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রসারে সাহায্য করবে।’ ২০১৭ সালের জুন মাসে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ন্যাশনাল হাইওয়েজ অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড এই প্রকল্প রূপায়নের কাজ শুরু করে। ভারতের ১৩৩ কোটি রুপি খরচ হয় সেতুটি নির্মাণে। একই দিনে প্রধানমন্ত্রী মোদি ২৩২ কোটি রুপি খরচ করে সাব্রুমে সুসংহত স্থল বন্দর বা আইসিপির শিলান্যাস করেন।  

বিশ্ব ব্যাঙ্কের সমীক্ষা অনুযায়ী, এই দুই দক্ষিণ এশীয় দেশ যোগাযোগ ক্ষেত্র থেকেই জাতীয় আয় অনেকটাই বাড়াতে পারে। ভারতের ৮ শতাংশ আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১৭ শতাংশ জাতীয় আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে যোগাযোগ শিল্প থেকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'এক দেশ থেকে অন্য দেশে গাড়ি চলাচলের ক্ষেত্রে দু-দেশ আস্থা অর্জন করতে পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার আরও বেড়ে যাবে। সড়ক পরিবহণের পরিকাঠামোর উন্নয়ন আর টেরিফ ও নন-টেরিফ বাধাগুলির নিষ্পত্তি ঘটিয়ে মটোর ভেহিক্যালস অ্যাক্ট সংশোধন করে দু-দেশ যদি একে অন্যের আস্থা অর্জন করতে পারে তবে সীমাহীন উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে।' তবে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রতিবেদন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার 'ট্রাস্ট ডেফিসিট' দূর করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। 

মৈত্রী সেতুকে বলা হচ্ছে, উত্তর পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার। কথাটি একশো ভাগ সত্যি। চট্টগ্রাম বন্দরের নিকটবর্তী ভারতের এই স্থলবন্দি রাজ্যগুলির অধরা বাজার খুলে গিয়েছে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির জন্য। এখন দু-দেশেরই উচিত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। উভয় দেশের সরকারই অবশ্য সেই পথেই এগোচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ৮টি রেলপথ ছিলো। কিন্তু ১৯৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় সেই পথ বন্ধ হয়ে যায়। এখন আবার সেগুলি চালু করার চেষ্টা হচ্ছে। ২০১৫ সাল থেকেই কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা, ঢাকা-শিলং-গৌহাটি বাস চলতে শুরু করেছে। বাস চলছে ঢাকা-খুলনা-কলকাতা রুটেও। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ সরকার চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে ভারতকে। 

শক্তি সংযোগ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে বড় মাধ্যম। হাইড্রোকার্বন খাতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সহযোগিতা তেল ও গ্যাস খাতের পুরো মূল্য শৃঙ্খলে বৈচিত্র্যময় করছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে দ্বিপাক্ষিক হাইড্রোকার্বন বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩৩৭ দশমিক ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পার্বতীপুর থেকে শিলিগুড়ি অবধি হাইস্পিড ডিজেল পাইপ লাইন নির্মানের কাজ চলছে। দুটি অগভীর জলের ব্লক নির্মাণে ভারত ২৪ দশমিক ২৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশে। ২০১৯-এর অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও মোদি যৌথভাবে বাংলাদেশ থেকে রান্নার গ্যাস রপ্তানির প্রকল্প উদ্বোধন করেন। এই প্রকল্পের ফলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি চট্টগ্রাম থেকে বাংলাদেশি ট্রাকে করে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে এলপিজি সরবরাহ নিশ্চিত হয়েছে। ইন্ডিয়ান ওয়েল কর্পোরেশন এখন বাংলাদেশে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ ওয়েল, গ্যাস অ্যান্ড মিনারেল কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা)-এর সঙ্গে অকাধিক কর্মকাণ্ডের যুক্ত হয়েছে।

ভারতর ও বাংলাদেশে এখন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ক্ষেত্রেও জোয়ার এসেছে। বর্তমানে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ভারতের বাণিজ্যের মাত্র ১ শতাংশ এবং বাংলাদেশের বাণিজ্যের মাত্র ১০ শতাংশ। দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যের ক্ষেত্রে এখনও বহু সমস্যা রয়ে গিয়েছে। গত দশ বছরে ৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২০১৭-য়  ৪.৫ বিলিয়ন, ২০১৬ ২ বিলিয়ন এবং ২০১০-এ ১ বিলিয়ন ডলার এলওসি) লাইন অফ ক্রেডিট দিয়েছে ভারত। বন্ধুত্বের সুবর্ণ জয়ন্তীতে উভয় দেশই বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি (সিইপিএ) স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত। ভারতীয় শিল্পপতিরাও বাংলাদেশে খাদ্য প্রকিয়াকরণ ও গাড়ি শিল্পে বিনিয়োগ করতে উতসাহ দেখাচ্ছে।
 
সামরিক ক্ষেত্রেও দু-দেশের সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। উভয় দেশের সামরিক কর্তারা নিজেরাই আলোচনার মাধ্যমে সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নিচ্ছেন এখন। উভয় দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী নিয়মিত অংশ নিচ্ছে যৌথ মহড়ায়। চিকিৎসা বা প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও ফৌজি বন্ধুত্ব বিরাজমান। সন্ত্রাস দমনে উভয় সেনাই 'সম্প্রীতি' যৌথ প্রশিক্ষণে সফলভাবে নিয়মিত অংশ নিচ্ছে। দিল্লিতে ২৬ জানুয়ারির প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে বাংলাদেশের তিন বাহিনীর ১২২ জনের দলটির অংশ গ্রহণ সম্পর্ককে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে।

পানি বন্টন নিয়েও সমস্যার অবসান ঘটাতে চায় ভারতের বর্তমান সরকার। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাধ্যবাকতা কখনওই দু-দেশের সম্পর্ককে খারাপ করতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফরকালে তিস্তার পানী বন্টন নিয়ে আলোচনা করার সম্ভাবনা প্রবল। 

এছাড়াও ৬টি অন্য নদী, রহিমপুর খাল নিয়েও আলোচনা হতে পারে। আসলে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককেও আরও উন্নত করতে চায়। চায় দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন সমস্যার দ্রুত সমাধান। কোভিড অতিমারির সময়ও বন্ধুত্বের বার্তা দিয়েছে উভয় দেশ। করোনা প্রতিরোধে বাংলাদেশকে ২০ লাখ কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন উপহার হিসাবে দিয়েছে ভারত। বাংলাদেশও ভারত থেকে ৫০ লাখ ডোজ করোনা টিকা কিনেছে। 

অতীতের পথ ভুলে ভারত ও বাংলাদেশ এখন একসঙ্গে ঘণীষ্টভাবে কাজ করতে আগ্রহী। সীমান্তের উভয় পারের সাধারণ মানুষদের উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার বহর বাড়াচ্ছে দুই বন্ধু প্রতিবেশী। দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার  মাধ্যমে আর্থিক অগ্রগতিই এখন দুদেশের লক্ষ্য। আর এই আর্থিক অগ্রগতিই দুই বন্ধু দেশের সাধারণ মানুষের উন্নয়নকে তরান্বিত করবে। সেই লক্ষেই এগোচ্ছেন প্রধানমন্তী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। 

ইত্তেফাক/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন