বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঐতিহাসিক সফর

আঞ্চলিক কানেকটিভিটির মাধ্যমে অর্থনীতির পরিসর বাড়বে

আপডেট : ১২ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৫১

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর উভয় দেশের সম্পর্ককে উন্নীত করেছে অনন্য উচ্চতায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পাশাপাশি উভয় দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেরও অর্ধশতক পূর্ণ হয়েছে এবার।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে সফরে আসেন নরেন্দ্র মোদি। উদ্যাপন অনুষ্ঠানে মুজিব কোট পরে উপস্থিত হন তিনি। অনুষ্ঠানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভারতের পক্ষ থেকে দেওয়া ‘গান্ধী শান্তি পুরস্কার’ হস্তান্তর করেন নরেন্দ্র মোদি। প্রবর্তনের পর এবারই কোনো মরণোত্তর ব্যক্তিত্বকে এই পুরস্কার দেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা তার হাত থেকে এ পুরস্কার গ্রহণ করেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির এটা দ্বিতীয় ঢাকা সফর। এর আগে ২০১৫ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন মোদি। এবারের সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিলিত হন নরেন্দ্র মোদি। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বানানো একটি করে সোনা ও রুপার কয়েন মোদিকে উপহার দেন শেখ হাসিনা।

এছাড়া স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে সাজানো একটি রুপার কয়েন দিয়েছেন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। অন্যদিকে বাংলাদেশকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে করোনা প্রতিরোধক ১২ লাখ ডোজ টিকা উপহার দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। বঙ্গবন্ধুকন্যা ভারতের এই প্রীতি উপহার অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসাসেবায় সহযোগিতার অংশ হিসেবে শেখ হাসিনার হাতে ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্সের প্রতীকী চাবি উপহার হিসেবে দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ২৭ মার্চ ২০২১, বিকেল ৫টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে দুই দেশের স্বাস্থ্য, বাণিজ্য, সংযোগ, বিদ্যুত্ ও উন্নয়নমূলক সহযোগিতাসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে উন্নয়নের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন তারা। এরপর ঢাকা-নিউ জলপাইগুড়ির মধ্যে ‘মিতালী এক্সপ্রেস’ ট্রেনসহ বিভিন্ন প্রকল্পের ভার্চুয়াল উদ্বোধন করেন দুই প্রধানমন্ত্রী।

কূটনৈতিক সুসম্পর্কের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও নরেন্দ্র মোদির এবারের বাংলাদেশ সফর ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বাংলাদেশে সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মোট পাঁচটি সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অভিযোজন ও প্রশমনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) ও ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর অব ইন্ডিয়ার (আইএনসিসি) মধ্যে সহযোগিতা, বাণিজ্য বিকাশে অশুল্ক বাধা দূর করতে একটি সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা, বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল সার্ভিস অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিজিএসটি) সেন্টারের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি সরঞ্জাম, কোর্সওয়্যার ও রেফারেন্স বই সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ সহযোগিতা ও রাজশাহী কলেজ মাঠের উন্নয়নে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন। স্মারকগুলো উভয় দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সম্প্রসারণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক ভারসাম্য বাংলাদেশের অনুকূলে আনা এবং বাণিজ্য অবারিত করার উদ্দেশ্য সামনে রেখে ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন মেজারস (টিএফএম) নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। উভয় পক্ষ ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ প্রতিবন্ধকতা অপসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। বাংলাদেশ থেকে পাটজাত পণ্য রপ্তানির ওপর ২০১৭ সাল থেকে ভারত কর্তৃক আরোপিত এন্টিডাম্পিং ডিউটিস প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হয়েছে। স্থলবন্দরগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করার ওপরও দুই প্রধানমন্ত্রী জোর দেন। হারমোনাইজেশন অব স্ট্যান্ডার্ডস বিষয়ে বিএসটিআই ও ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস (বিআইএস)-এর মধ্যে নিবিড় সহযোগিতার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রে বর্ধিত হারে ভারতীয় বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আঞ্চলিক কানেকটিভিটির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন দুই নেতা। সড়ক, রেল ও নৌপথে মাল্টিমোডাল কানেকটিভটির মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী উদ্যোগসমূহের প্রশংসা করেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। ‘ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ‘ট্রাইলিটারাল হাইওয়ে’ প্রকল্পে যুক্ত হতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা ভারতকে জানানো হয়েছে। বিবিআইএন মোটর ভেহিকেলস চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের মধ্যে ‘ত্রিদেশীয় সমঝোতা স্বাক্ষর’টি দ্রুত সম্পন্নের প্রয়োজনীয়তার ওপর দুই নেতা বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন।

ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে আরো বৃহত্তর পরিসরে নতুন কিছু রুট অনুমোদনের জন্য ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে আঞ্চলিক কানেকটিভিটি আরও বাড়বে। বাংলাদেশ থেকে নেপালে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে দূরত্ব, সময় ও ব্যয় বহুলাংশে হ্রাস পাবে এবং বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। ফেনী নদীর ওপর সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া ‘মৈত্রী সেতু’র কথা উল্লেখ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে পরিবহন সংযোগ স্থাপনের বিষয়ে বাংলাদেশের উদার সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদি আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার ওপর বাংলাদেশের অলঙ্ঘনীয় অধিকারের বিষয়টি বরাবরের মতোই জোরালোভাবে উত্থাপন করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি তিস্তার পানি বণ্টনের ‘অন্তর্বর্তী চুক্তি’ দ্রুত সম্পাদনের জোর দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি জানান, চুক্তিটি দ্রুত স্বাক্ষরে ভারত আন্তরিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং এ বিষয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার—এই ছয়টি rans-boundary নদীর পানি বণ্টনের অন্তর্বর্তী চুক্তির ফ্রেমওয়ার্ক চূড়ান্তকরণের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে দুই দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ‘Upper সুরমা-কুশিয়ারা সেচ প্রকল্পে’ কুশিয়ারা নদীর পানি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে রহিমপুর খালের অবশিষ্টাংশ খননের আবশ্যকতার ওপর গুরুত্বারোপ করে ‘কুশিয়ারা নদীর পানি withdrawal-এর জন্য প্রস্তাবিত MoU” স্বাক্ষরে ভারতের দ্রুত সম্মতি কামনা করেছে বাংলাদেশ।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান সহযোগিতা, বিশেষত নেপাল ও ভুটানকে সঙ্গে নিয়ে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।seasonal complementarities ও ব্যয় সাশ্রয়ের নিরীখে নেপাল ও ভুটানে উত্পাদিত জলবিদ্যুত্ ব্যবহারে আগ্রহী বাংলাদেশ। ভুটানের সঙ্গে সদ্য সম্পাদিত Joint Statement-এও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে আজ আমরা energy surplus দেশে পরিণত হয়েছি। আমরা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের energy-deficit এলাকায় বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে চাই। লাইন অব ক্রেডিটের আওতাধীন প্রকল্পগুলোকে আরো বেগবান করার ব্যাপারেও দুই প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেছেন। এ বিষয়ে গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটিকে তারা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।

দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বৈঠকের পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মাজারেও পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সেনানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। টুঙ্গিপাড়া থেকে নরেন্দ্র মোদি যান গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে। সেখানে মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে পূজা দেন। এর আগে সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী পৌরাণিক শক্তির কেন্দ্র সাতক্ষীরার শ্যামনগরে যশোরেশ্বরীর কালীমন্দিরে পূজা দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এই প্রথম বাইরের কোনো প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপ্রধান ঢাকার বাইরে এমন সফর করলেন, যা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য বড় পাওয়া।

বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক সেরা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিগত ১০ বছরে দুই দেশের মধ্যে শ-খানেক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, এর মধ্যে গত তিন বছরেই সই হয়েছে ৬৮টি চুক্তি। ছিটমহল আর সমুদ্রসীমা নিয়েও দুই দেশ সমাধানে পৌঁছাতে পেরেছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা সরকারের বিগত এক দশকে উভয় দেশের মধ্যে বিভিন্ন প্রথাগত খাত যেমন নিরাপত্তা, বাণিজ্য, বিদ্যুত্, জ্বালানি, যোগাযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, জলবায়ু ও পরিবেশ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, জনযোগাযোগ বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতে সহযোগিতা প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন নতুন ও অপ্রচলিত খাত যেমন ব্লু ইকোনমি ও মেরিটাইম, পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, মহাকাশ গবেষণা, ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ রপ্তানি এবং সাইবার সিকিউরিটি প্রভৃতি খাতে উভয় দেশ একে অপরের দিকে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করেছে।

নিরাপত্তা, ব্যবসায় ও বাণিজ্য, বিদ্যুত্ ও জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, নদী ও সামুদ্রিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৬০টিরও বেশি দ্বিপক্ষীয় প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া রয়েছে। উভয় দেশই বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এবারের সফরে সেই প্রতিশ্রুতিই যেমন পুনর্ব্যক্ত করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। দক্ষীণ এশীয় ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারত-বাংলাদেশের উষ্ণ সম্পর্ক অংশীদারিত্বমূলক উন্নয়নের পথ সুগম করছে।

লেখক: পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

ইত্তেফাক/এএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন