একজন লেখক কেন লেখেন? প্রখ্যাত গল্পকার সাদত হাসান মান্টোকে একবার প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘অনুভূতি যখন আহত হয়, তখনই সে কলম তুলে নেয়।’ একজন সংবেদনশীল নাগরিক হিসেবে আমরা আহত হই যখন আমাদের দেশ যে ধারণাকে ধারণ করে সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে আঘাত করা হয়, আঘাত করে ক্ষত সৃষ্টি করা হয়।
বর্তমান সাম্প্রদায়িকতার আস্ফালন আমাদের রাষ্ট্র ধারণার উপর পদাঘাত। কারণ সাম্প্রদায়িকতাকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে সম্প্রীতির সংস্কৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল। অধ্যাপক নুরুল ইসলাম তার ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়া-পাকিস্তান-বাংলাদেশ : এ প্রাইমর অন পলিটিক্যাল হিস্ট্রি’ বইয়ের শুরুতে (পৃ. ১১) উইন্সটন চার্চিল থেকে উদ্ধৃত করেছেন, ‘ইন্ডিয়া ওয়াজ এ কনসেপ্ট অ্যান্ড নট এ কান্ট্রি।’ কেননা ব্রিটিশ রাজের পূর্বে ভারতবর্ষের বিশাল এলাকা একটি একক অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। সেখানে বহু প্রিন্সলি স্টেট বা গোত্রপ্রধান শাসিত অঞ্চল ছিল। ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হয় এবং একক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এর একদিন আগে ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্ব হিন্দু-মুসলিম আইডিয়ায় ভর করে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। যার ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীন হয় জাতীয়তাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতিতত্ত্ব আইডিয়ার মাধ্যমে। রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় জনসংখ্যা, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার আর সার্বভৌমত্বের যে রাষ্ট্রবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকে, বাংলাদেশের তা আছে। সেই হিসেবে বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র এবং স্থিতিশীল রাষ্ট্র। আকবর আলী খানের মতে অন্যদের সাথে পার্থক্যটা এই যে, ভাষা ও গোত্রের ভিত্তিতে পাকিস্তানি জাতির ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদও স্থিতিশীল নয়। সে দিক থেকে বাঙালি জাতি স্থির এবং পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। আমাদের নিকট বাংলাদেশ একটি আইডিয়ার নাম, অনুভূতির নাম।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের ধারণা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যে ধারণা বা আদর্শকে ভিত্তি করে সার্বভৌম পতাকা অর্জিত হয়েছিল সে পতাকা মাঝেমাঝেই হাতবদল হয়েছে। সাম্প্রদায়িক অপশক্তি জাতির পতাকাকে করেছে অপমান, অবজ্ঞা। প্রধানমন্ত্রী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ভাষণে কবি নজরুল থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, ‘চাহিনা জানিতে বাঁচিবে অথবা মরিবে তুমি এ পথে, এ পতাকা বয়ে চলিতে হইবে বিপুল ভবিষ্যতে।’ অপার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতে পতাকা বয়ে চলার জন্য চাই দৃঢ় মনোবল। তাই প্রার্থনা ‘তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি।’
এ কথা সত্য যে, পতাকা বয়ে চলা সহজ নয়। তবে ‘চেতনা রয়েছে যার সে কি পড়ে রয়?’ তাই আমাদের জাতীয় চেতনা স্মরণ করা দরকার। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উল্লাস দেখে সন্দেহ জাগে আমরা কী এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। সা’দত আলী আখন্দ ১৯২৮ সালে বলেছেন, ‘বাঙালি মুসলিম সমাজ ধর্মের নামে বড়াই করতে গিয়ে জাতীয়তার দাবীকে উপেক্ষা করেছেন। ...তাঁরা “নেশন” ও “রিলিজিয়ন”- এর একই অর্থ করে বসেছেন।’ পরে অবশ্য মোহভঙ্গ ঘটে। ১৯৪৭-৪৮ সাল হতেই ‘জাতির পরিচয় মানে ধর্মীয় পরিচয় নয়’- এই আলোচনা শুরু হয়ে যায়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা।’ তারপরেও সাম্প্রদায়িক সংঘাত আমাদের দেখতে হয়েছে, হচ্ছে। নতুন প্রজন্মকে বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের ধারণা সম্পর্কে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। জাতিরাষ্ট্রের ধারণায় ধর্ম মুখ্য নয়, গৌণও নয়। গ্যারি জে. ব্যাস তাঁর ২০১৩ সালে প্রকাশিত ‘দি ব্লাড টেলিগ্রাম: ইন্ডিয়াস সিক্রেট ওয়ার ইন ইস্ট পাকিস্তান’ বইয়ে (পৃ. ১৬২) হেনরি কিসিঞ্জার এবং পি এন হাকসারের মধ্যকার একটি কথোপকথন তুলে ধরেন। সেখানে কিসিঞ্জার পাকিস্তানের ভাঙনের পরিস্থিতির জন্য ভারতকে দোষারোপ করলে হাকসার বলেন, ‘যদি ধর্মই জাতিরাষ্ট্রের ভিত্তি হতো তাহলে সম্ভবত ইউরোপ এখনো হোলি রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকতো।’
এটা স্পষ্ট, বাংলাদেশ একটি নেশন স্টেট, ধর্মীয় রাষ্ট্র না, সাম্প্রদায়িকতা নয়ই। কীভাবে এ জাতিরাষ্ট্র গঠিত হলো? কীভাবে জাতিরাষ্ট্র গঠিত হয়? রাজনীতি বিজ্ঞানী বেনেডিক্ট এ্যান্ডারসন ‘ইমাজিন কমিউনিটি’ লেখায় জাতীয়তাবাদকে মতাদর্শগত দিক থেকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘মানুষ নিজেকে সমগোত্রীয়ভুক্ত কল্পনা করে বলেই একসাথে থাকে, এক রাষ্ট্র গঠন করে।’ ভাষা ও সংস্কৃতি তাকে এরূপ কল্পনা করতে বাধ্য করে। এতে নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি হয়। ফরাসি বিপ্লবে ঐ বোধ কাজ করেছিল। জাভা-ভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বন্ধন তৈরি হয় ভাষাগত মিলের কারণেই।
বঙ্গবন্ধু ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে উদাত্ত আহ্বানের মাধ্যমে ভাষা ও ভ্রাতৃত্বের বোধ জাগ্রত করতে পেরেছিলেন বাঙালির মধ্যে। বাঙালির কল্পনা তখন শুধু স্বপ্নবৎ থাকেনি। তারা সমগোত্রীয়তার বোধ হতে উৎসারিত বাঙালি জাতীয়তাবাদে বলীয়ান হয়ে জাতিরাষ্ট্র বিনির্মাণ করে। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাঁর ‘বাংলাদেশ : জাতির অবস্থা’ শীর্ষক আলোচনায়ও ‘বাংলাদেশের মানুষ একটি জাতি, কারণ তারা একটি জাতি হতে চায়, অন্য কিছু নয়’ উল্লেখ করেছেন। বাঙালি হতে চাওয়ার এই জেদ হল আমাদের জাতিরাষ্ট্রের ধারণা বা চেতনা। যে চেতনা বাঙালিকে সুখে-দুঃখে-গর্বে একই পরিচয়ে পথ চলতে উৎসাহিত করেছে। এই চেতনায় আঘাত বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের উপর আঘাত। নিয়ত উৎকর্ষতার মাধ্যমে এ চেতনা পরিশীলিত হয়। কিন্তু বাঙালির এই চেতনা বিনাশে চক্রান্তকারীরা শুরু হতেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা নিজেদেরকে নিতান্ত দুর্ভাগা ভেবে ভুট্টোর সুরে কথা বলে- ‘রাষ্ট্র তো কেবল ভৌগোলিক বা সীমানা নির্ভর ধারণা নয়। যখন জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত ও ধর্ম অভিন্ন, তখন দূরত্ব কোনো সমস্যা নয়।’ হাসান ফেরদৌস (২০০৯), ১৯৭১ : বন্ধুর মুখ, শত্রুর ছায়া, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, পৃ. ১২৮। এক ধর্মের দোহাই দিয়ে এক পতাকার স্বপ্ন যেমন ভুট্টো দেখতেন, তেমন অনেকেই এখনো এ স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু কেন সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, ভুট্টো-মোশতাক-মওদুদির প্রেতাত্মারা এখনো বর্তমান? স্বাধীনতার ৫০ বছরে পদার্পণ করেও কী সে আত্মজিজ্ঞাসার সময় আসেনি?
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে দেখিয়েছেন, ভিখারিনী পাঁচী তার পায়ের থকথকে তৈলাক্ত ঘা জিইয়ে রাখে। ঔষধে সারায় না। নিজের স্বার্থে প্রদর্শন করে। ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার করে। সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ন্যাকড়ায় বাঁধা এমন দগদগে ঘা মাঝে মাঝেই ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের মধ্যে ক্ষত সৃষ্টি করে। অথচ ১৯৪৭ সালে যে ধর্মীয় আইডেনটিটির ভিত্তিতে দেশভাগ হয় ১৯৭১ সালে তার মীমাংসা হয়। কিন্তু তারপরেও যুগে যুগে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দেশ প্রত্যক্ষ করে চলেছে। ১৯৯৭ সালে ভারত ভাগের ৫০ বছর পূর্ণ হয়। সে বছর প্রকাশিত ‘দি আইডিয়া অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে সুনীল খিলনানী ভারতের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র হয়ে ওঠার ধারণা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ভারতের গণতান্ত্রিক আইডিয়া ভারতকে বিশ্বমঞ্চে একটি শক্তিশালী অবস্থান করে দিয়েছে। রাজনীতি বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা যখন ‘অ্যান্ড অব হিস্টরি’ বা ইতিহাসের পরিসমাপ্তি বলেন তখন ইতিহাস নয়, একটি আইডিয়ার পরিসমাপ্তির কথা বলেন। অর্থাৎ যে মৌলিক ধারণাকে ভিত্তি করে একটি জাতি গঠিত হয় সে ধারণার অবসান যেন জাতিরই যবনিকাপাত। কারণ সমগোত্রীয়তার ধারণা তৈরি করতে না পারলে জাতীয় পরিচয় টিকে থাকে না। তাই বাঙালির জাতিরাষ্ট্র ধারণার বিনাশ ঘটলে বাংলাদেশ থাকবে না। ‘নগর পুরিলে দেবালয় কি এড়ায়?’
আমাদের রাষ্ট্র বিনির্মাণের ধারণা বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতার মানবিক মূল্যবোধ। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ লেখেন, ‘অনেক রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের জন্ম। বাইরের দুনিয়ায় দ্বিজাতিতত্ত্বের বেলুনটা ফুটো হয়ে গেলেও বাংলাদেশের ভেতরে বড় একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই তত্ত্বের আগুন ধিকি ধিকি করে জ্বলছিল [জ্বলছে]। একাত্তরে আগুনটা সাময়িকভাবে চাপা পড়েছিল। ক্রমেই তার শিখাটা লকলকে জিহ্বা বের করতে থাকে।’ মহিউদ্দিন আহমদ (২০১৭), আওয়ামী লীগ : যুদ্ধদিনের কথা ১৯৭১, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, পৃ. ১৫১। সাম্প্রদায়িকতার লকলকে জিহ্বা স্পষ্ট দেখা যায় যখন হাজার বছরের বাংলার সংস্কৃতি, জাতির পিতার স্বপ্ন আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিদ্রূপ করা হয়। বিদ্রূপ করা থেকে তাদের শুরু, শেষটা রাষ্ট্র ধারণা বিনাশে গিয়ে ঠেকবে না তো? ‘বনের মাঝারে যথা শাখাদলে আগে, একে একে কাঠুরিয়া কাটি, অবশেষে নাশে বৃক্ষে।’ তেমনি সাম্প্রদায়িক দুরন্ত রিপুরা আমাদের আদর্শ-চেতনার বৃক্ষকে সমূলে বিনাশে নিরন্তর রত। আর সে কারণে আমাদের চেতনাও লোপ পাচ্ছে। আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের জন্মের ইতিহাস, ত্যাগের ইতিহাস, অনুভূতির ইতিহাস, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ধারণার ইতিহাস তথা জাতির পিতার আদর্শের ইতিহাস। তাই প্রতিবাদের নৈতিক শক্তিও দিন দিন হারিয়ে ফেলছি। দেশের জন্য যারা সংগ্রাম করেছেন তাঁরা আজ সাম্প্রদায়িকতার জয়রব দেখে ভাবছেন, স্বাধীনতার যুদ্ধে ‘কেন না শুইনু আমি শরশয্যোপরি।’
লেখক: পাবলিসিটি অফিসার, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম।
ইত্তেফাক/জেডএইচডি