শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

শামসুদ্দীন মোল্লা রাজপথেই ছিলেন

আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৫৬

অধ্যাপক সাইদুর রহমান তার ‘শতাব্দীর স্মৃতি’ বইয়ে বঙ্গবন্ধু, শামসুদ্দীন মোল্লা ও তাদের আরেক সহপাঠী সরোয়ারজান মিয়াকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক একটি লেখা লিখেছেন। লেখক উল্লেখ করেছেন শামসুদ্দীন মোল্লা নীতি বদলাননি, তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গেই ছিলেন। অধ্যাপক সাইদুর রহমান কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ) বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক ছিলেন। দর্শন বিষয় পড়াতেন। তিনি বেকার হোস্টেলের সুপারও ছিলেন। স্মৃতি লিখেছেন বেকার হোস্টেল নিয়ে। ঐ কলেজে একই ক্লাসে পড়তেন বঙ্গবন্ধু, শামসুদ্দীন মোল্লা ও ফরিদপুরের আরেকজন সরোয়ারজান মিয়া। সেই থেকে শামসুদ্দীন মোল্লা বঙ্গবন্ধুর বন্ধু, রাজনীতির মাঠে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী। যদিও শামসুদ্দীন মোল্লা বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বয়সে এক বছর এক মাসের ছোট ছিলেন। মোল্লার জন্ম ১৯২১ সালের ২০ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানায়। আজ শামসুদ্দীন মোল্লার জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হলো।

শামসুদ্দীন মোল্লা প্রমাণ করে গেছেন, আওয়ামী লীগের সবাই মোশতাক হয় না, সবাই বেইমান হয় না। আমৃত্যু তিনি কতটা নিবেদিত ছিলেন সেকথাই আজ তার জন্মদিনে বিশেষভাবে উল্লেখের দাবী রাখে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ায়, ঐ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকার রাজপথে প্রথম প্রকাশ্য মিছিল বের হয় ৩ নভেম্বর। সে মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন শামসুদ্দীন মোল্লা। সেনা বাধা উপেক্ষা করে মিছিল যায় বত্রিশ নম্বরে। বত্রিশ নম্বর বাড়ির গেটে বসে মোনাজাতের মাধ্যমে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন শামসুদ্দীন মোল্লা। ঐ দিন বিকালেই জিয়াউর রহমান শামসুদ্দীন মোল্লাকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়ে মাইকিং করান। যার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে গিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন তিনি এবং যশোরের রওশন আলী।

শামসুদ্দীন মোল্লা যখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সংগঠিত হচ্ছেন, দেশের ভেতর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের সঙ্গে যোগ দিতে থাকলেন। ঠিক সেই সময় ভারতে সরকার পরিবর্তন হয়ে গেল। ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতা হারালেন। ক্ষমতায় এলেন শরণ সিং। তিনি এসে এদের ভাতা বন্ধ করে দিলেন। পরবর্তী সময়ে বনগাঁ এলাকার কংগ্রেসদলীয় এমপি শামসুদ্দীন মোল্লাকে ডেকে বললেন, ‘আমি একটা পথে আপনাদের সহযোগিতা করতে পারি, কাজের বিনিময়ে খাদ্য। আপনাদেরকে রাস্তায় মাটি কাটতে হবে, তার বিনিময়ে খাবার খাবেন।’ বাধ্য হয়ে সে পথই ধরলেন তিনি। রাস্তায় মাটি কাটতে হয়েছে শামসুদ্দীন মোল্লাসহ প্রতিবাদে যোগ দেওয়া নেতাকর্মীদের।

শামসুদ্দীন মোল্লা ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে ঘনিষ্ঠ হন তাদের আরেক বন্ধু শহিদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন। বঙ্গবন্ধু উদ্যোগ নিয়ে শামসুদ্দীন মোল্লার বোনকে বিয়ে দেন সিরাজুদ্দীন হোসেনের সঙ্গে।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী শামসুদ্দীন মোল্লা রাজনীতির পাশাপাশি ছিলেন আইনজীবী ও সাংবাদিক। কাজ করেছেন দৈনিক ইত্তেফাকে। ফরিদপুর প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতির সভাপতিও হয়েছিলেন। বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সহসভাপতি ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ফরিদপুর জেলা বারের সভাপতি ও বার কাউন্সিলের সহসভাপতি ছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন ফরিদপুর আইন মহাবিদ্যালয়সহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

আজীবন বিপ্লবী এই নেতা মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী। জিয়া সরকার তাকে মন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন, ঘেন্নাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। দল বদলাননি, আদর্শ বদলাননি। অদ্ভুত একটা মিল ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ছোটবেলা থেকেই শামসুদ্দীন মোল্লা প্রতিবাদী স্বভাবের ছিলেন। স্কুল জীবনে ভাঙ্গা পাইলট স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে থাকতেই শিক্ষকের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন তিনি। তখন সেই স্কুলে গোপালগঞ্জ থেকে আসেন সেই প্রতিবাদে অংশ নিতে শেখ মুজিবুর রহমানও। তখন থেকেই ছিল দুজনের নিবিড় বন্ধুত্ব। শামসুদ্দীন মোল্লা তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পর্যন্ত আমি ছিলাম তাঁর সবচেয়ে পুরোনো সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বঙ্গবন্ধু বলতেন, Molla is my oldest colleague and closest friend.’

খ্যাতিমান এই রাজনৈতিক নেতা ১৯৯১ সালের ১০ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন।

লেখক: সাংবাদিক

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন