শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রমজানের অর্থনীতি, মূল্য ব্যবস্থাপনা ও বাজার মনিটরিং

আপডেট : ০৪ মে ২০২১, ১০:৩৮

রমজান মাস পবিত্র, বরকতময়, সংযম ও ধৈর্যের বার্তাবাহী একাট গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মাস সিয়াম সাধনার মাস, আত্মশুদ্ধির মাস। ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা অধীর আগ্রহে এই মাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এ বছর একই সঙ্গে পহেলা বৈশাখ ও মাহে রমজান ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে এমন একটি সময়ে, যখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেশের মানুষের জীবন-জীবিকাকে বিপদগ্রস্ত করে তুলছে। দ্বিতীয় প্রবাহ মোকাবিলায় আবারও দেশে চলছে লকডাউন, যা কবে শেষ হবে তা অনিশ্চিত। লকডাউনের কারণে স্থানীয় সরবরাহব্যবস্থাও কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা সব মিলিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজার আরো অস্থির হওয়ার আশঙ্কা বিধায় সামনের দিনে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ও বাজার স্থিতিশীল রাখাই মূল চ্যালেঞ্জ।

রমজানের ফজিলতের কথা কম-বেশি আমরা সবাই জানি; কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ী বেশি মুনাফা অর্জনের আশায় এই সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে কোন পণ্য রমজান মাসে বেশি ব্যবহূত হবে, রোজাদাররা কোন পণ্য দাম বাড়লেও কিনতে চাইবে কিংবা তারা রোজার অনেক আগে থেকেই খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। অন্যদিকে দেখা যায়, রমজান মাসটা যেন খাদ্যোৎসবের মাস, যেখানে রোজাদারেরা বেশি বেশি খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত থাকে। দাম যতই বাড়ুক না কেন, বেশি দাম দিয়ে হলেও তা কিনতে হবে। ইফতার বা সেহরিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার না থাকলে রোজা যেন পূর্ণতা পায় না। কেউ কেউ রমজান মাসের কথা চিন্তা করে আগে থেকেই প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ঘরে মজুত করতে থাকে। ঈদ সামনে রেখে শুরু হয় কেনাকাটার ধুম। রমজানের প্রকৃত ফজিলত নিয়ে তেমনভাবে ভাবনার বিষয়টি কম দেখা যায়।

নিম্ন আয়ের মানুষ বছরের এ মাসটিতে কীভাবে রোজা রাখবে বা উচ্চমূল্য দিয়ে দ্রব্যাদি কিনে কীভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবন নির্বাহ করবে; এটি নিয়ে দেশের অধিকাংশ বিত্তশালীকে কম ভাবতে দেখা যায়। বিশেষত বর্তমান বছরে লকডাউনের কারণে নানা শ্রেণি-পেশার সাধারণ মানুষের আয় কমেছে, বিশেষ করে দিনমজুরের আয় বলতে গেলে বন্ধ তথা রমজানের এই সময়ে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দামে তাদের ভোগান্তি বেড়েছে। অর্থনীতি গবেষণা সংস্থা সানেম বলছে, দেশে দারিদ্র্যের সার্বিক হার বেড়েছে, যা গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে পরিচালিত জরিপ থেকে পাওয়া তাদের হিসাবে দেশে দারিদ্র্যের হার ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। রমজান এলে এ দেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রস্তুতি তৈরি হয়, তারা এই পবিত্র মাসে আধ্যাত্মিকভাবে পুণ্য অর্জনের জন্য প্রস্তুতি নেন, আবার কেউ প্রস্তুতি নেন সেহরি-ইফতারসহ নানা উদযাপনের জন্য। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে খ্রিষ্টান, হিন্দু, বৌদ্ধসহ সব সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ী যেখানে বিশেষ ছাড় দিয়ে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে ধর্মীয় পর্বের উপহার নিয়ে আসেন সাধারণ ক্রেতার কাছে, সেখানে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা রমজানে ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নামেন, যা কাম্য নয়। যেমন বাংলাদেশে রমজান মাস শুরু হওয়ার আগেই বাড়তে থাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য, যা ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ হচ্ছে পণ্যবাজারে।

নিম্নমুখী আয়ের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে নিত্য-নৈমিত্তিক ক্রয়ক্ষমতার ওপর, যেখানে দাম স্থিতিশীল থাকলেও সাধারণ মানুষের জন্য তা বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রোজার মাসে কেন জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে? উত্তরে বলা হবে, চাহিদা বাড়ছে, তাই জোগানের স্বল্পতায় ভারসাম্য আনতে গিয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে। আদৌ কি তাই? পণ্যগুলো কী পরিমাণ লাগবে, এগুলো কি আমাদের অজানা? কোন কোন দ্রব্য কী পরিমাণে দরকার তা জানা থাকলে, কেন পণ্যের জোগানের স্বল্পতা দেখা যায়? কেন দাম হু-হু করে বেড়ে যায়? নাকি কৃত্রিমভাবে সংকট তৈরি করে জোগানের স্বল্পতার দোহাই দিচ্ছি আমরা? চাহিদা অনুযায়ী বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে পূর্ণমাত্রায় ভারসাম্য বজায় থাকবে। শুধু পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করলেই হবে না, সব পেশার মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর লক্ষ রেখে সরকারকে পণ্যের ন্যায্যমূল্য ঠিক করে দিতে হবে। সংবিধানমতে, ভোক্তাসাধারণের জন্য দাম সহনীয় রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, যার জন্য প্রয়োজন ক্রমাগত বাজার ব্যস্থাপনা ও বাজার মনিটরিং। তার মধ্যে ব্যতিক্রমও আছে। যেমন একজন ব্যবসায়ী বলছেন, দোকান খোলা রাখা হয়েছে লাভের জন্য নয়, কেবল বেঁচে থাকার জন্য, কর্মচারীদের বেতন ও দোকানের ভাড়া পরিশোধের জন্য, যা জীবনের এক নতুন শিক্ষা বলে বিবেচিত।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বিপর্যস্ত অর্থনীতি, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগব্যবস্থা, অবিন্যস্ত বন্দর ইত্যাদি প্রেক্ষাপটে পর্যাপ্ত নিত্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল জরুরি ভিত্তিতে জোগান দেওয়া এবং ন্যায্যমূল্যে নিত্যপণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আশির দশকে মুক্তবাজার অর্থনীতি বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সীমিত হয়ে আসে, যা পরবর্তী সময়ে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকারি-বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয় জোরদারে সরকারি উদ্যোগের অপরিহার্যতা বিবেচনা করে বর্তমান সরকার টিসিবিকে গতিশীল ও শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নেয়। সংকটকালে ভোক্তাদের কাছে নিত্যপণ্য সরবরাহে বিকল্প বাজার সৃষ্টিতে টিসিবি প্রতিষ্ঠা করা হলেও জনবান্ধব, সরকারি কর্মকর্তানির্ভর ও ভোক্তাদের প্রতিনিধিত্বহীন হওয়ার কারণে এই অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সফল হয়নি। তবে বর্তমানে করোনাকালে বাড়ছে ইকমার্সের চাহিদা এবং এখন থেকে অনলাইনেও নিত্যপণ্য যেমন ভোজ্য তেল, ছোলা, চিনি ও মসুর ডাল বিক্রি করছে সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। মাহে রমজানে ঘরে বসে স্বস্তির বাজার কার্যক্রমের আওতায় শুরু হওয়া এ পণ্য বিক্রি চলবে আগামী ৬ মে পর্যন্ত। ইকমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ই-ক্যাব) ডিজিটাল হাট ডট নেটের আটটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে এসব পণ্য বিক্রি শুরু করছে। টিসিবি ট্রাক সেলের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ন্যায্যমূল্যে দেশব্যাপী বিক্রি করছে বিশেষত স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ যাতে এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, সেজন্য সরকার ইকমার্সের সহযোগিতায় ভোজ্য তেল, ছোলা, চিনি ও ডাল বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বাজার গবেষকবৃন্দ বলছেন, নিয়ন্ত্রণহীন বাজারে একটি বিষয় সব সময় লক্ষ করা যায়, যেমন যখন খুচরা ব্যবসায়ীকে প্রশ্ন করা হয়, এই পণ্যের দাম বেশি কেন? তার তাৎক্ষণিক উত্তর হবে পাইকারি বাজারে দাম বেশি বলে। কিন্তু একই বাজারে যখন খুচরা বিক্রির তিন দোকানে তিন রকম দাম দেখা যায়, তখন মনে প্রশ্ন জাগে, যা গবেষককে ভাবিয়ে তোলে এর কারণ কী? এর মানে হচ্ছে, বাজার মনিটরিং বলতে কিছু নেই। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, চিনি থেকে শুরু করে ভোজ্যতেল খাদ্য ও কৃষি খাতের সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। একই পরিস্থিতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল, কয়লাসহ প্রায় সব ধরনের জ্বালানি পণ্যের ক্ষেত্রে। এমনকি কৃষির অপরিহার্য উপকরণ সারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বিশ্ববাজারে ঊর্ধ্বমুখী মূল্য মানেই এসব পণ্য বাড়তি দামেই কিনতে হবে বংলাদেশকে। মানুষের জীবনধারণ, কৃষি, অবকাঠামো, শিল্পসহ পুরো অর্থনীতিতে এর প্রভাব অনেক। আন্তর্জাতিক বাজারের অত্যধিক নির্ভরতায় বারবারই দামজনিত অভিঘাতের সম্মুখীন হতে হয়, যার একটা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান জরুরি এবং সেক্ষেত্রে দেশে নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে অন্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্যগুলোর অভ্যন্তরীণ উত্পাদন কীভাবে বাড়ানো যায় তার দিকে নজর নিতে হবে, বিশেষত করোনাকালে এর প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি অনুভূত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীও কৃষিপণ্যের অভ্যন্তরীণ উত্পাদন বাড়ানোর বিষয়টি বারবার জোর দিচ্ছেন, যা বিবেচনায় নিয়ে কৃষি দপ্তরকে বিশেষ সক্রিয় হতে হবে। ইহা সত্য যে অভ্যন্তরীণ উত্পাদন বাড়লেও বাজারে পণ্যের দাম সহনীয় না-ও থাকতে পারে যেমন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দাম নির্ভর করে নির্বিঘ্ন ও পর্যাপ্ত সরবরাহের ওপর। দেশে ফড়িয়া, মধ্যস্বত্বভোগী ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির ঘটনা প্রায়ই ঘটে, যার ফলে পর্যাপ্ত জোগান থাকলেও দাম বেড়ে যায়। তাই বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে খাদ্যপণ্যের সরকারি মজুত বৃদ্ধি ও সিন্ডিকেটের কারসাজির দিকেও কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে, বাজারে চালাতে হবে নিয়মিত অভিযান, দায়ীদের চিহ্নিত করে নিশ্চিত করতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজারে রাষ্ট্রের কার্যকর নজরদারি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

লেখক: গবেষক, অর্থনীতিবিদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন