শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মোস্তফা হত্যা মামলা

জোসেফ, হারিস ও আনিস কি সুবিচার পেয়েছিলেন?

আপডেট : ১১ মে ২০২১, ০১:৪৬

পর্ব-৩

আমি আমার পূর্ববর্তী দুটো পর্বে যে চিত্র বারবার আঁকার চেষ্টা করেছি, সেটা নিয়ে একটা প্রশ্ন আসতেই পারে যে, মোস্তফা যদি সন্ত্রাসী হয়ও, তাহলে তার হত্যাকাণ্ড তো মিথ্যা হতে পারে না কিংবা তার মৃত্যু তো সেই কারণে মিথ্যা হতে পারে না। আমি এই যুক্তির সঙ্গে একমত। কিন্তু আমার এই ‘মোস্তফার চিত্র’ আঁকার যে প্রধান কারণটি মাথায় ছিল, সেটি হচ্ছে একজন ‘জাত অপরাধীর’ কিছু প্রচ্ছন্ন গতি-প্রকৃতি রয়েছে, যেগুলো চাইলেই সেই অপরাধী নিজের ভেতর থেকে বিলুপ্ত করতে পারে না, বরং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপরাধী তার অপরাধের একটা চিহ্ন এঁকেই যায়।

এ কথা যখন আমি লিখছি, তার সঙ্গে আরেকটি ঘটনা এখানে যোগ হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স ম্যান’ নামের যে কল্পিত তথ্যচিত্র কাতারভিত্তিক টিভি চ্যানেল ‘আলজাজিরা’ গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রচার করেছে, সেখানে এক রহস্যময় কারণে এই নিহত মোস্তফাকে বারবার একজন নিরীহ, সত্ ব্যবসায়ী হিসেবে দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। যখনই আমি এই মোস্তফা হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্তে নামি, আমার কাছে উন্মোচিত হয় মোস্তফার আরেক পরিচয়—যে পরিচয়ে মোস্তফা আসলে একজন ব্যবসায়ী—এই চরিত্র আর থাকে না। যে চরিত্রে মোস্তফাকে দেখা যায় একজন টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, খুনি ও দেশের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসীর একজন হিসেবেই।

প্রসঙ্গে ফিরে এসে বলতে হয়, মোস্তফা যে একজন ভয়ানক সন্ত্রাসী ও খুনে প্রকৃতির লোক ছিলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মোস্তফাকে কেন খুন হতে হলো আর এই খুনের মামলায় ঠিক কীভাবে তোফায়েল আহমেদ জোসেফ, হাসান আহমেদ হারিস কিংবা আনিস আহমেদের নাম জড়িয়ে গেল? কী হয়েছিল সেদিন? এই হত্যা মামলার সাক্ষী কারা? তদন্ত রিপোর্টেই বা কী লেখা ছিল কিংবা মামলার সুরতহাল রিপোর্ট, ময়নাতদন্ত রিপোর্টে? কী ছিল নিম্ন আদালতের রায়ে অথবা হাইকোর্ট ও অ্যাপিলেট ডিভিশনের রায়ে?

এর প্রতিটি বিষয়ের ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে আমি আবারও চলে যেতে চাই তত্কালীন মোহাম্মদপুরের কিছু স্থানীয় হিসাব-নিকাশ আর রাজনীতির দিকে। বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদের তিন কন্যা আর পাঁচ পুত্র। ওয়াদুদ সাহেবের পাঁচ পুত্র জোসেফ-হারিস-আনিস-আজিজ-টিপু সাহেব কিংবা তাদের তিন বোন অথবা তাদের বাবা ওয়াদুদ সাহেব এবং মা রেনুজা বেগমের জীবনটাই শুরু হয়েছে এই তিলোত্তমা ঢাকায় এক দুঃস্বপ্ন দিয়ে। ওয়াদুদ সাহেব বাংলাদেশ বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্মচারী ছিলেন। হাউজবিল্ডিং থেকে ঋণ নিলেন, গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করলেন। ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটা দোতলা বাড়ি কিনলেন পুরো পরিবার নিয়ে থাকার জন্য। এই গল্প আশির শেষ কিংবা নব্বইয়ের দশকের শুরুর। একদিন দখল হয়ে গেল বাড়িটি। এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে পুরো পরিবার রাস্তায়। মেজো ছেলে আজিজ আহমেদ তখন মেজর। তার পোস্টিং হয়েছে ঢাকার বাইরে। তাদের পিতা গ্রামে গেছেন কিছু জমি বিক্রি করতে, ঋণের কিছু অংশ শোধ করার জন্য। ঠিক এই সময়ে ঘটে এই দখলের গল্প।

জোসেফ এই শহরে জীবনযাপন শুরু করেছিলেন আমার-আপনার মতো একেবারেই সাধারণ তরুণের মতো। জোসেফ নিজেও অসম্ভব ভালো ছাত্র ছিলেন। সেই সময় তিনি যুক্ত হন মোহাম্মদপুরের স্থানীয় রাজনীতিতে। যুক্ত হন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে। আজিজ আহমেদ নিজের মহিমাতেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চলে গেলেন। নিজের ক্যারিয়ার গড়তে লাগলেন। বড় ভাই আনিস পুরো পরিবারকে ওঠানোর চেষ্টা করেন বাবার সঙ্গে। হারিসও রাজনীতিতে, বিশেষ করে যুবলীগের রাজনীতিতে তখন দাঁড়িয়ে গেছেন। নিজের একটা প্রতিবিম্ব তৈরি করার চেষ্টা করছেন এই শহরে। টিপু ঘরের শান্ত ছেলে। সব থেকে মেধাবী আর যুক্তির আবরণে মোড়া সে। কিছুটা আবেগে আক্রান্তও। একেবারে উচ্চমাধ্যমিকে থাকতেই বোধকরি প্রেম করে বিয়ে করে ফেলেন। এটাও বলে রাখা ভালো যে সাঈদ আহমেদ টিপু, তিনিও রাজনীতির খাতায় নাম লিখিয়েছেন।

আমি আগের পর্বগুলোতেই বলেছি যে সেই সময়ে জেনারেল এরশাদের জন্য সবচাইতে কঠিন ছিল আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে মোকাবিলা করা আর সে কারণেই তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ফ্রিডম পার্টি’ নামের দলটিকে পরিচয় করান শুধু আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য। মোহাম্মদপুরের স্থানীয় রাজনীতি যদি আমরা লক্ষ করি, তাহলে শুরুতেই বলতে হবে এই চৌহদ্দির ভৌগোলিক অবস্থা। বলা যায়, ঢাকা শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র এই এলাকা। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের কাছেই ছিল ফ্রিডম পার্টির একটি অফিস আর তাদের মূল অফিস ছিল ধানমণ্ডির ৩৬ নম্বর রোডে। এই পুরো ব্যাপারটি যদি আমরা আরেকটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল নয়, আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করতে অনেকটা এরশাদের মাসলম্যানরূপে তখন একেবারে পরিকল্পিতভাবেই হাজির করা হয় ফ্রিডম পার্টিকে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তত্কালীন অধিকাংশ সভা-সেমিনার ইত্যাদির ওপর বড় বা ছোট যতগুলো হামলা হয়েছে, যতগুলো সভা-সেমিনার পণ্ড হয়েছে, তার অধিকাংশগুলোতেই দেখা গেছে ফ্রিডম পার্টির ক্যাডারদের মূল ভূমিকা ছিল।

সারা দেশে যখন ফ্রিডম পার্টির তাণ্ডব, তখন এই মোহাম্মদপুরে শক্তিশালীভাবে দাঁড়িয়ে যান হারিস-টিপু-জোসেফ। একটা বিষয় মাথায় রাখা জরুরি যে ওয়াদুদ সাহেবের বড় ছেলে আনিস আহমেদ কিন্তু তখন রাজনীতিতে নেই। তিনি পরিবারটিকে বাঁচানোর জন্য তার নিজ ব্যবসাতেই মনোযোগী হয়েছেন। জোসেফ-হারিসকে এই মোহাম্মদপুরে রাজনীতি করার জন্য যে সংগ্রাম করতে হয়েছে, সেটির বিরুদ্ধশক্তি হিসেবে কেবল ফ্রিডম পার্টিই যে আবির্ভূত হয়েছে তা নয়, বরং সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতা হাজি মকবুলের নানাবিধ কূটচাল আর কূটরাজনীতি তখন সেই অঞ্চলে আওয়ামী লীগের ঐক্যকে দুইভাবে বিভক্ত করে রেখেছে। হাজি মকবুল তার রাজনীতিকে আরো শক্তিশালী করার জন্য দেখা গেল এমন অনেক নেতাকর্মীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া শুরু করেছিলেন, যারা আদর্শগতভাবে কোনো দিনই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেনি। শুধু হারিস-জোসেফ-টিপুদের রুখে দেওয়ার জন্য হাজি মকবুলের এই অপরাজনীতি শুধু এই স্থানের আওয়ামী রাজনীতিকেই নয়, বরং তত্কালীন ঢাকা মহানগরের রাজনীতির ভিতকেই দুর্বল করে দিচ্ছিল। আওয়ামী রাজনীতির এই বিভক্তি এতটাই প্রকট ছিল, যার পুরো সুযোগ তখন গ্রহণ করেছিল আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তিগুলো। কিন্তু এই বৈরী পরিবেশেও হারিস-জোসেফ-টিপুদের নিজ নিজ রাজনীতি অন্যদিকে জনপ্রিয়তার দিক থেকেও তারা ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে যেতে লাগলেন সবাইকে।

১৯৯১ কিংবা ’৯২-এর দিকের একটি ঘটনা। মোহাম্মদপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী মোর্শেদ একদিন অতর্কিতে হামলা করে ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ জোসেফকে। জোসেফের পীঠের পেছন দিয়ে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। পরবর্তীকালে জানা যায়, মোর্শেদের যে গ্যাং মোহাম্মদপুরে চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিল, তাদের একজন সদস্যকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করার জের ধরে এই ছুরি হামলা ঘটানো হয়। হামলাকারীদের অভিযোগ হচ্ছে, জোসেফ তাদের দলনেতাকে ‘সম্মান’ করে কথা বলেননি। আপাতদৃষ্টিতে এই পুরো ঘটনা বিস্ময়ের ও হতবিহ্বল হওয়ার মতো হলেও তত্কালীন বাস্তবতা ছিল এমনই। একদিকে এরশাদের জাতীয় পার্টির দেশ জুড়ে প্রভাব আর তাণ্ডব, অন্যদিকে ফ্রিডম পার্টির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আমি বারবার একটি জিনিস পাঠকদের বোঝানোর সুবিধার্থে লিখছি যে আসলে ঠিক কেমন ছিল তত্কালীন ঐ মোহাম্মদপুর অঞ্চলের রাজনীতি আর ঠিক কেমন বৈরী পরিবেশে জোসেফ-হারিস-টিপুদের রাজনীতি করতে হয়েছে।

ছুরি ঢোকানোর পর সেটি অনেকটা ছিন্নভিন্ন করে দেয় জোসেফকে। ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার। দীর্ঘদিন সে যন্ত্রণায় কাটিয়েছে, এখনো কাটায়। বস্তুত, জেলের দীর্ঘ সময় সেই নব্বইয়ের দশকের ছুরির আঘাত তাকে ছাড়েনি। নব্বইয়ের দশকে মোর্শেদের সন্ত্রাসী বাহিনী পেছন থেকে রডের বাড়ি দিয়ে মাথার পেছনটা থেঁতলে দিয়েছিল। সেখান থেকেও বেঁচে ফিরেছেন জোসেফ। এক সন্ধ্যায় মোর্শেদ আর তার বাহিনী জোসেফদের মোহাম্মদপুরের বাসাটা আক্রমণ করে বসে। জোসেফ কিংবা হারিস কিংবা আনিস কেউই ছিলেন না বাসায়। ব্রাশফায়ার করে নরককুণ্ড বানিয়ে দেয় ওয়াদুদ সাহেবের বাড়িটি। কোনো বিচার পায়নি ওরা বিএনপির আমলে। সে সময় আরো প্রভাবশালী ছিল সলু, সেতুসহ মোহাম্মদপুরের আরো অনেক ছোট ও মধ্য সারির নেতারা। ১৯৯৩ সালে না ফেরার দেশে চলে যান ওয়াদুদ সাহেব। জোসেফ-আনিস-হারিস-আজিজ-টিপুর বাবা। পুরো পরিবারের মাথার ওপর থেকে সরে যায় এক বটবৃক্ষ।

এই সমাজবাস্তবতা, এই নিষ্ঠুর মানুষেরা, এই রাজনীতি, এই জীবন জোসেফকে নিয়ে এসেছে এমন একটি জীবনে, যেখানে শেষ পর্যন্ত ফেরার রাস্তা থাকে না। হয় থাকো, না হয় হত্যার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। জোসেফের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যায়। আর কত অত্যাচার সহ্য করা! বোনেরা স্কুলে যেতে পারে না, দুই দিন পরপর বাসায় আক্রমণ, পুলিশ পাঠানো। পুরো পরিবার অতিষ্ঠ।

এক দিনের ঘটনা, বড় ভাই আনিস সাহেব বিছানার সঙ্গে লাগানো মশারির স্ট্যান্ড খুলে জোসেফকে পেটান। পেটাতে পেটাতে সিদ্ধান্ত নেন, মেরেই ফেলবেন আজকে জোসেফকে। তার একটাই কথা, ‘তুই কেন এসবে গেলি? কে তোকে বলেছে রাজনীতি করতে?’ আমরা এই গল্পে যে জোসেফকে দেখতে পাচ্ছি, সেই জোসেফের নানা জন্ম হয়েছে। জন্ম আর পুনর্জন্ম হতে হতে আজকে সমাজ খুব কায়দা করে নাম দিয়েছে ‘সন্ত্রাসী জোসেফ’। কিন্তু যারা মোহাম্মদপুরে বড় হয়েছেন বা এখানকার রাজনীতিকে সূক্ষ্মভাবে দেখেছেন, তারা জানেন এই গল্পগুলো।

লেখক :আইনজীবী

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন