শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সভ্যতার কিছু যায়-আসে না!

আপডেট : ১৭ মে ২০২১, ১০:১৮

যে ভূখণ্ড থেকে আসা শিশু-নারীসহ নিরপরাধ মানুষের অপঘাত মৃত্যুর খবর দুনিয়াবাসীর অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেছে, সেটি গাজা। দুনিয়ার বৃহত্তম ছাদহীন এই জিন্দানখানায় ইহুদি বাহিনীর মারণমহড়ার তাই নির্মোহ দর্শক সভ্য দুনিয়া। মরতে মরতে ক্রমে বিলুপ্তির দিকে ধাবমান ফিলিস্তিনিদের আরেক ভূখণ্ড পশ্চিম তীরও মৃত্যুপুরী।

এ দুই ভূখণ্ডেই ইসরাইলি খুনেবাহিনী নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যার মাধ্যমে হাত মশকো করে, ক্ষেপণাস্ত্রের নিশানা পরখ করে, গোলার আঘাতের ধ্বংসযজ্ঞ মেপে দেখে। এভাবেই বছরের পর বছর ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র, গোলাগুলি আর রাসায়নিক অস্ত্রে খুন হচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিনিরা। এ বারও ইসরাইলের নির্ভুল নিশানায় নারী-শিশুসহ নিরস্ত্র মানুষ।

গাজার চতুর্দিকেই ইহুদিদের চৌপ্রহর প্রহরা, বিপুলাকার দেওয়াল, গুলি-গোলা-ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফাঁক গলে কোনোমতে টিকে থাকা লাখ ১৫ গাজাবাসীর ওপর পর্বতসম চাপ জায়নবাদী ইসরাইলের সর্বাত্মক অবরোধ। গাজার আসমানটি খোলা বটে, তবে সেখানে ইসরাইলের জঙ্গিবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, বোমার ঝাঁকের দেখাই বেশি মেলে! অবরুদ্ধ জনপদটির বাতাসও ভরে গেছে রাসায়নিক হামলার মারণ-বিষে। সেই বিষ দেহে ধারণ করে জন্মাচ্ছে বিকলাঙ্গ, পঙ্গু শিশু। ফিলিস্তিনি শুধু এই পরিচয়ে আর ১০ জনের মতো সেই শিশুদেরও স্বাভাবিক মৃত্যুর ভাগ্য নেই! এবং এই মৃত্যু যখন তখন; ধর্মীয় উৎসবের দিন বা প্রার্থনার সময় কিছুই বাধা নয় ইসরাইলি যুদ্ধবাজ বাহিনীর কাছে। এ কারণে ঈদের দিনও প্রাণ দিতে হয় ফিলিস্তিনিদের, ঈদের পোশাক পরা শিশুদের বেঘোরে মৃত্যুও একই নিয়তি-নির্দিষ্ট।

গুলিগোলায় ছিন্নভিন্ন, আগুনে-বিস্ফোরণে দগ্ধ, কংক্রিটের চাপায় পিষে-থেঁতলে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের লাশের মিছিল তাই থামে না। বধ্যভূমি, মৃত্যুপুরী, জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ—কোনো বিশেষণেই ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা, তাদের ওপর চালানো নৃশংসতা স্পষ্ট হয় না; কিছুতেই মেলে না ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দরিয়ার কিনারা।

ফিলিস্তিনের ভূমি-ভিটে জবরদখল, অন্যায্য বিতাড়ন আর অবৈধ ইহুদি বসতিস্থাপনের আনুপাতিক হারে ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা কমানোর সব ইন্তেজাম পাকা ইসরাইলের। ইঙ্গ-মার্কিন মহব্বত, মদতে বলবান ইসরাইলের একতরফা আগ্রাসনক্ষেত্র গাজা, পশ্চিম তীর মায় গোটা ফিলিস্তিন ভূমি। ফিলিস্তিনের বুকের পাঁজর গুঁড়িয়ে ইহুদিদের এই দখলবাজি চলছে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে। তবু সভ্যতার মুখে রা নেই; চোখে ঠুলি পরা তার, মাফলারে ঢাকা কান!

সভ্যতার বয়স নাকি ৫ হাজার বছর। আর কবে সে ‘পরিণত’ হবে? নাকি সে বুড়িয়ে গেছে? দেশে দেশে ইসরাইলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে রাজপথে নামা মানুষের ক্ষোভ-ধিক্কারেও কীভাবে সে নির্বিকার থাকে? সভ্যতার সভ্য হওয়ার বয়ান যত দিস্তা দিস্তা কাগজে লিখিত, ফিলিস্তিনিদের অশেষ বঞ্চনা, করুণ মৃত্যু, তাদের নিপীড়নের রক্তাক্ত ইতিকথা কি তার চেয়ে কম কাগজে ধরবে? তেমনি অশেষ ফিলিস্তিনিদের ইন্তিফাদার দুর্ধর্ষ ইতিবৃত্তও।

ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কি কেবল ফিলিস্তিনিদের আত্মিক, ন্যায্য ও আইনসংগত দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ? নাকি তা আজ বিশ্বজনীন মানবমুক্তিরও প্রাণভোমরা? পঙ্গু শিশুর বেড়ে ওঠার অধিকারও যখন ছিনিয়ে নেওয়া হয়, পাখি শিকারের উল্লাসে খুন করা হয় অগণিত নিরস্ত্র মানুষ, তখন মুখ বুজে থাকলে বিবেকও কি কণ্ঠহীন থাকে? মানবতা তো কিতাবে ছাপা কোনো ধারণামাত্র নয়, ন্যায্যতায় সমর্থন জানাতে না পারলে মানবতাও বিলুপ্ত হতে বাধ্য।

নাস্যিদের থেকেও অধিক জিঘাংসু হয়ে উঠেছে জায়নবাদীরা। তাদের একপেশে বর্বর হামলা, অবরোধ-আগ্রাসনে, চিকিত্সাহীনতায় অকাল আর অপঘাত মৃত্যুই যেন ফিলিস্তিনিদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কত রক্তমূল্য শোধে মানবমুক্তির পয়গাম পৌঁছাবে ফিলিস্তিনে?

লেখক: সাংবাদিক

ইত্তেফাক/এমআর

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন