বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

পুলিশকে বিচারিক ক্ষমতা প্রদানে বিতর্ক

আপডেট : ২৮ মে ২০২১, ০১:০৩

করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধের প্রধান উপায় সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, যেমন—জনসমাবেশ না করা ও সমাবেশে না যাওয়া, মুখে মাস্ক পরা, অন্যের সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি।

সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ মোতাবেক সংক্রমণের বিস্তার রোধ করার জন্য সরকার লকডাউন ও নানাবিধ বিধিনিষেধ আরোপ করে থাকে। জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকার যেসব বিধিনিষেধ জারি করে, তা পালন করা সব নাগরিকের কর্তব্য। কিন্তু একশ্রেণির লোক এসব বিধিনিষেধের প্রতি উদাসীন। তারা এমনকি মাস্কও পরে না।

অসচেতনতা ও দায়িত্বহীনতার কারণে তারা নিজের ও অন্যের জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি আইন, বিধি ও সরকারের নির্দেশনা পালনের জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ আবশ্যক। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা মোবাইলকোর্ট করে মাঝে মাঝে আইন ও সরকারি নির্দেশনা অমান্যকারীদের জরিমানা করে থাকেন। কিন্তু বিধি ও সরকারি নির্দেশনা অমান্যকারীদের সংখ্যা এত বেশি ও বিস্তৃত যে কিছুসংখ্যক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া দুষ্কর। তাই করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।

সম্প্রতি মিডিয়ায় এই মর্মে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যে, সরকার করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে নাগরিকদের আইন ও বিধিনিষেধ মানানো তথা আইন প্রয়োগের জন্য পুলিশকে সীমিত আকারে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। এসংক্রান্তে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মহোদয় ঈঙ্গিতও দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে নানা মহল আপত্তি তুলেছে এবং বিতর্ক শুরু করেছে।

সরকার ঘোষিত লকডাউন বা বিধিনিষেধ যখন লঙ্ঘিত হচ্ছে, মানুষ মাস্ক পরছে না, মার্কেট, যানবাহন ও টার্মিনালগুলোতে গাদাগাদি করে মানুষ ভিড় জমাচ্ছে, তখন সচেতন নাগরিকেরা পুলিশি অ্যাকশনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তাদের বলতে শোনা যায়, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কোথায়? মিডিয়া রিপোর্টেও বলা হয়, পুলিশ নাই অথবা পুলিশ নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ মনে করে, আইন মানানোর দায়িত্ব পুলিশের। তারা মনে করে, পুলিশ চাইলেই মানুষ মাস্ক পরবে ও বিধিনিষেধ মেনে চলবে। একশ্রেণির মানুষকে জোর করেই আইন মানাতে হবে।

পুলিশ দেশের প্রধান আইন প্রয়োগকারী ও তদন্ত সংস্থা। আইন প্রয়োগ করাই পুলিশের কাজ। কিন্তু তা আইনের মধ্যে থেকেই করতে হয়। আইন পুলিশকে ক্ষমতা না দিলে পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে পারে না। দেশে অনেক আইন আছে। যে আইন পুলিশকে প্রয়োগ করার ক্ষমতা দিয়েছে, পুলিশ শুধু সে আইনই প্রয়োগ করতে পারে। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮তে পুলিশকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। এমনকি জাতীয় কমিটিতে স্বরাষ্ট্রসচিব ও পুলিশের কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি। বিধিনিষেধ কেউ না মানলে কিংবা কেউ মাস্ক না পরলে পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থাই নিতে পারবে না, শুধু অনুরোধ করতে পারবে। এতে পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয় না। আইনের বাধ্যবাধকতা না থাকায় পুলিশের মধ্যেও অনেকটা শৈথিল্য থাকে।

মোটরযান আইনে আইন অমান্যকারীদের ঘটনাস্থলে তাত্ক্ষণিক জরিমানা করার ক্ষমতা বরাবরই পুলিশের ছিল। আইনেই পুলিশের এ ক্ষমতা আছে। পুলিশ স্পটে আইন লঙ্ঘনকারীদের শুধু জরিমানা করতে পারে, জেল দিতে পারে না। পাবলিক প্লেসে আইন অমান্য করায় সাধারণত আইন অমান্যকারী চ্যালেঞ্জ করে না, দোষ স্বীকার করে নেয়। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে পুলিশ সেই মামলা আদালতে বিচারের জন্য পাঠিয়ে দেয়। কেউ জরিমানা দিতে না চাইলে তার মামলাও পুলিশ আদালতে পাঠিয়ে দেয়। আদালত শুনানি নিয়ে তার বিরুদ্ধে জেল বা জরিমানার আদেশ দিয়ে থাকেন।

করোনা সংক্রামক প্রতিরোধের জন্য নাগরিকদের মাস্ক না পরা বা অন্য বিধিনিষেধ অমান্যকারীদের ট্রাফিক আইনের ন্যায় জরিমানা করার ক্ষমতা পুলিশকে দেওয়া যায়। জরিমানার অঙ্কও নির্ধারণ করে দেওয়া যায়। সর্বোচ্চ ৫০০ বা ১ হাজার টাকা নির্ধারণ করা যায়। জরিমানার টাকা সরকারের নির্দিষ্ট হিসাবে জমা হবে। যাকে জরিমানা করা হবে সে একটি স্লিপ পাবে। ডাকঘর ১০০, ২০০ বা ৫০০ টাকার করোনা জরিমানা স্ট্যাম্পও মুদ্রণ করে পুলিশের কাছে বিক্রি করতে পারে। পুলিশ যাকে জরিমানা করবে, তাকে স্বাক্ষরিত স্ট্যাস্প দিয়ে টাকা আদায় করতে পারে।

কেউ কেউ বলে, পুলিশ ক্ষমতার অপব্যবহার করবে। অসংখ্য আইনে পুলিশকে ক্ষমতা দেওয়া আছে। পুলিশ কি শুধু ক্ষমতা অপব্যবহারই করে? মানুষের ও দেশের কল্যাণে আইনের প্রয়োগ করে না? বাতাসের মধ্যে বসবাস করলে অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায় না। যেখানে বাতাস নেই, সেখানে বাস করলে অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায়। সেই অবস্থা পুলিশের ক্ষেত্রেও। আইন ও পুলিশ আছে বলেই আপনি-আমি নিরাপদে আছি। রাতে ঘুমাতে পারি। কাজকর্ম করতে পারি। চলাফেরা করতে পারি। এই বাস্তবতা বুঝেই পুলিশকে মূল্যায়ন করা উচিত।

কেউ কেউ বলতে পারেন, পুলিশ ক্ষমতা চায়। আসলে তা ঠিক নয়। পুলিশ কোনো ক্ষমতা চায় না। পুলিশের ক্ষমতার প্রয়োজনও নেই। এমনিতেই পুলিশকে অনেক আইনগত দায়িত্ব পালন করতে হয়। আসলে পুলিশের কোনো ক্ষমতাই নেই। ক্ষমতা তো আইনের। আইন করা হয় জনগণের স্বার্থে। দেশ ও সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য। পুলিশকে শুধু আইন প্রয়োগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পুলিশ শুধু তাদের ওপর অর্পিত আইনগত দায়িত্বটুকু পালন করে। কেউ আইনের অপপ্রয়োগ করলে তার দায় তার নিজের এবং সেজন্য তাকে জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। পুলিশও আইনের ঊর্ধ্বে নয়।

করোনা প্রতিরোধে পুলিশ কোনো ক্ষমতা চায় না। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারের বিধিনিষেধ নাগরিকদের মান্য করাতে পুলিশকে শুধু স্বল্প অঙ্কের জরিমানা করার ক্ষমতা দিলে তা জনস্বার্থেই হবে। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮তে সংশোধনী এনে এ ক্ষমতা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর বা সার্জেন্ট ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তারা প্রয়োগ করতে পারবেন এমন বিধান রাখা যায়। জরিমানা করার ক্ষমতাকে বিচারিক ক্ষমতা না বলে বৃহত্তর বিবেচনায় আইন প্রয়োগের অংশ হিসেবে আইনগত দায়িত্ব পালন বলাই শ্রেয়। যে কাজ পুলিশ ট্রাফিক আইনের ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকেই করছে, শুধু সেই কাজই করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে করবে।

এ নিয়ে আপত্তি ও বিতর্ক করার কোনো মানে হয় না। মাঠে সর্বদা পুলিশই থাকে। পুলিশ যেভাবে কাজ করতে পারবে, অন্যদের হয়তো সেই সুযোগ নেই। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ মোবাইলকোর্ট আইন, ২০০৯ অনুযায়ী যে ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন, তা কতটুকু সংবিধানসম্মত তা নিয়ে তো আইনি বিতর্ক আছে। যা কিছুই করা হচ্ছে, তা জনস্বার্থেই করা হচ্ছে। পুলিশকেও জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার সরকার জনস্বার্থেই ব্যবহার করবে। এ ক্ষেত্রে মহল বিশেষের হইচই করার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে প্রতীয়মান হয় না।

লেখক :সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ

ইত্তেফাক/এসআই

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন