বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

রুশ-মার্কিন সম্পর্কের সম্ভাব্য গতিপথ

আপডেট : ১৪ জুন ২০২১, ০৪:৩০

ইউরোপ মহাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে দুই পক্ষের মতপার্থক্যের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রুশ-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গতিপ্রবাহ রীতিমতো অস্থিতিশীল। উল্লেখ্য, স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের মধ্য দিয়ে মস্কো-ওয়াশিংটন সম্পর্কের দীর্ঘ বৈরিতার যবনিকাপাত ঘটে। দুই পক্ষের মধ্যে সৃষ্টি হয় একধরনের আস্থার পরিবেশ। কিন্তু এই স্থিতাবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মাত্র দেড় যুগ পরেই আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মতবিরোধ বাড়তে থাকায় হঠাত্ স্থবির হয়ে পড়ে রুশ-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক।

মূলত গত দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই এই প্রেক্ষাপটের সূত্রপাত নতুন স্নায়ুযুদ্ধের পূর্বাভাস হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা। অবশ্য নিকট অতীত রুশ-মার্কিন সম্পর্ক অবনতির সূত্রপাত ঘটে চলতি শতাব্দীর শুরুর দিকে। ঐ সময় ইউরোপের নিরাপত্তা বিধানকল্পে সেখানে নতুন করে সামরিক তত্পরতা শুরু করে আমেরিকা। ওয়াশিংটনের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ মস্কোর পালটা পদক্ষেপে পালটে যায় ইউরোপের রাজনৈতিক, সামরিক সমীকরণের চিত্র। ফলে ইউরোপকে কেন্দ্র করে অনেকটা মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায় রুশ-মার্কিন সম্পর্ক। তাই সাম্প্রতিক সময়ের রুশ-মার্কিন সম্পর্কের পরিক্রমা ও এর সামগ্রিক পরিস্থিতি বর্ণনা করতে হলে আলোচনায় যে কয়েকটি বিষয় অগ্রাধিকার পাবে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইউরোপ।

ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতিই রুশ-মার্কিন সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণে প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে থেকেছে সব সময়। কেননা ইউরোপ মহাদেশের কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে ঐ অঞ্চলে নিজের রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে রাশিয়ার আকাঙ্ক্ষা বহু আগে থেকেই বিরাজমান। অন্যদিকে আমেরিকা নিজের বৈশ্বিক ক্ষমতাপ্রবাহ নিরঙ্কুশ রাখতে ইউরোপের রাজনীতিতে রাশিয়ার উপস্থিতিকে সব সময় নিজের জন্য সত্যিকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করে থাকে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ উত্তর যুগে বৈশ্বিক ক্ষমতাপ্রবাহের গতিপথ থেকে রাশিয়া ছিটকে পড়ায় আমেরিকা একক মোড়ল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। বিপরীতে আমেরিকা-ইউরোপ সম্পর্কে ছন্দপতনের আভাসও পাওয়া। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের বিস্তার ঘটিয়ে আমেরিকা নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে। এই বাস্তবতায় রাশিয়া, চীন একপাক্ষিক বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশি ভূমিকার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ঐ সময়ের মধ্যে কার্যকর অংশীদার হিসেবে রাশিয়া-ইউরোপ বন্ধুত্ব বেড়ে ওঠে। রাশিয়া-ইউরোপ সম্পর্কের এই বাস্তবতাকে নিজের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে—এমন আশঙ্কায় পড়ে ওয়াশিংটন। সংগত কারণেই রুশ-ইউরোপ সম্পর্কের উঠতি গতিপ্রবাহ শ্লথ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ওয়াশিংটন যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তার মধ্যে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায় পূর্ব ইউরোপের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক সুবিন্যস্ত করা।

একই সঙ্গে ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ককে বাস্তবসম্মত করে তোলা। এই প্রক্রিয়ায় দুটি সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটো জোটে টেনে নেওয়ার মার্কিন আগ্রহ রুশ-মার্কিন সম্পর্কে মারাত্মক ফাটলের সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে রুশ-মার্কিন ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সীমাহীন বিস্তার ঘটায়। বলা চলে এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত প্রতিফলন হিসেবে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালে ইউক্রেন সংকটের সূত্রপাত হয়। এই ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত পূর্ব ইউরোপীয় দেশ রুমানিয়া ও পোল্যান্ডে আমেরিকার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনের পরিকল্পনা। উল্লিখিত দুই ইস্যুতে মুখোমুখি ওয়াশিংটন-মস্কো পরস্পরের বিরুদ্ধে নানামুখী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ইউরোপীয় সীমান্ত বরাবর অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সমাবেশ ঘটায় উভয় পক্ষ। কিন্তু রাশিয়ার পালটা সামরিক তত্পরতাকে আগ্রাসনের উপলক্ষ্য বানিয়ে ইউরোপের ভীতি উসকে দিতে সক্ষম হয় মার্কিনিরা। বাস্তবতা হচ্ছে, ইউরোপে নজিরবিহীন মার্কিন শক্তির অনুপ্রবেশ অঞ্চলটিতে যুদ্ধের ঝুঁকি ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয়।

Good Cop/Bad Cop: The US and Russia Show

অবশ্য এর আগেই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক ক্ষমতার রূপান্তর ঘটার অবকাশে বিশ্বব্যাপী মার্কিন কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সুযোগকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগায় মস্কো। ফলে ইরানের পরমাণু প্রকল্প, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, কোরীয় উপদ্বীপের পরমাণু সংকট, আফ্রিকার উন্নয়ন ইত্যাদি ইস্যুতে রুশ-মার্কিন স্বার্থগত দ্বন্দ্ব সহসা স্নায়ুযুদ্ধ সময়ের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপ্রবণ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর মধ্যে গুটি কয়েক দেশ পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার সুযোগ খোঁজার পরিপ্রেক্ষিতে এই অঞ্চলে আমেরিকা ও ন্যাটোর তত্পরতা ঘিরে রাশিয়ার উত্কণ্ঠা বৃদ্ধি পায়। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের এই উত্তেজনা মূলত ন্যাটোর সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া ঘিরেই সাম্প্রতিক সময়ে আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। ইত্যবসরে আমেরিকা ইউরোপের সঙ্গে সৃষ্ট দূরত্ব কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে ইউক্রেন সংকটের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপীয় মিত্রদের এককাট্টা করার সাফল্য দেখায় মার্কিনিরা। এর ফলে স্নায়ুযুদ্ধ উত্তর যুগে ভঙ্গুর আন্তঃআটলান্টিক সম্পর্ক নতুন করে নির্ভার হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় রুশ-ইউরোপ সম্পর্ক। সমসাময়িক ইতিহাসের এই বাস্তবতা রুশ-মার্কিন সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার।

সংগত কারণেই এই মুহূর্তে বিশ্ববাসীর আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে আগামী ১৬ জুনের রুশ-মার্কিন শীর্ষ বৈঠক। যদিও সম্ভাব্য বৈঠকের আগেই নিজের প্রথম বিদেশ সফরে লন্ডন এসে রাশিয়াকে কড়া হুঁশিয়ারি শুনিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। অন্যদিকে জো বাইডেনের বক্তব্যের জবাবে রাশিয়া অভিনব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। মস্কোর ভাষ্য—আমরা মনে করি না এই বৈঠক থেকে বাস্তবিক কোনো ফলাফল আসবে। তবে কিছু বিষয়ে অগ্রগতি হলে আমরা খুশিই হব।

New Russian sanctions for US meat

আগামী ১৬ জুনের বৈঠকের সুনির্দিষ্ট কোনো এজেন্ডা নেই। তবে দুই দেশের শীর্ষ বৈঠকে বরাবরই অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। বিশেষ করে ব্যাপকভাবে পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত দুই দেশের কৌশলগত অস্ত্র হ্রাসের ব্যাপারটি বৈশ্বিক উত্তেজনার পারদ কমাতে সহায়তা করবে। কেননা দুটি দেশই নিজেদের প্রয়োজনেই কৌশলগত অস্ত্র হ্রাসসংক্রান্ত বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় কিংবা বহুপক্ষীয় চুক্তির অংশীদার। এধরনের কয়েকটি আন্তর্জাতিক চুক্তি নিয়েও দুই দেশের বনিবনা হচ্ছে না। সম্প্রতি পারস্পরিক মতবিরোধের জেরে ৩৫টি দেশের ‘উন্মুক্ত আকাশ চুক্তি’ থেকে আমেরিকার পথ অনুসরণ করে রাশিয়াও চুক্তি থেকে সরে এসেছে। এর আগে পরমাণু অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণসংক্রান্ত আইএনএফ চুক্তিটিও উন্মুক্ত আকাশ চুক্তির মতোই পরিত্যক্ত হয়। এছাড়া দুই দেশের মধ্যকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্টার্ট চুক্তির ভবিষ্যত্ নিয়েও অচলাবস্থা বিরাজ করছে। কিন্তু বাইডেন-পুতিন সম্ভাব্য আলোচনায় এই বিষয়গুলোর সুরাহা হওয়ার কোনো লক্ষণই পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

অন্যদিকে ইরানের পরমাণু চুক্তির ব্যাপারে মার্কিন অবস্থানের পরিবর্তন আনতে পুতিন কতটা সফল হবেন, তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। এই চুক্তির ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ভব্যিষত্। অন্যদিকে সাম্প্রতিক গাজা যুদ্ধের বিভীষিকা, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ভবিষ্যত্ নিয়ে দুই পক্ষ সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবে কি না সেটিও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, সাইবার নিরাপত্তা, কোভিড-১৯ টিকা ইত্যাদি ইস্যুতে দুই নেতার মধ্যকার আলোচনা ইতিবাচক হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে আমেরিকার পক্ষ থেকে রাশিয়ার বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনির ব্যাপারে আলোচনার প্রসঙ্গটি আসবে বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে।

করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্বে বাইডেন-পুতিনের সম্ভাব্য আলোচনায় খুব বেশি অগ্রগতি কেউই প্রত্যাশা করে না—এ কথা সত্য। কেননা বিভিন্ন কারণেই দুই পক্ষের মধ্যকার বিরাজমান মতপার্থক্য দ্রুত কমিয়ে আনা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। কিন্তু বিশ্ব নেতৃত্বের অংশীদার হিসেবে উভয় দেশের প্রেসিডেন্টদ্বয় দায়িত্বশীলতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেবেন—এমনটাই সবার প্রত্যাশা। তবে দেখার বিষয় হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে দুই নেতা কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন কি না।

লেখক :আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

ইত্তেফাক/টিআর

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন