শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

ভূমিকম্প: বিপদমুক্ত নয় বাংলাদেশ

আপডেট : ১৪ জুন ২০২১, ১০:২৯

ভূমিকম্প মানুষের কাছে এক ভয়ংকর বিভীষিকা। এর ফলে ব্যাপক ধ্বংসলীলা হয়ে থাকে। মাঝারি থেকে প্রবল ভূমিকম্পে বাড়িঘর ভেঙে পড়ে এবং ভগ্নস্তূপের নিচে চাপা পড়ে বহু লোক ও গৃহপালিত পশু মারা যায়। শর্টসার্কিট পাইপ ভেঙে শহর-জনপদে আগুন লেগে যায়। ভূমিকম্পের কারণে জলোচ্ছ্বাস বা নদীপ্লাবনের ফলেও অনেক লোক হতাহত হয় এবং মারা যায়। ধস নামার ফলে এবং ভূমিতে ফাটল সৃষ্টির কারণে রাস্তাঘাট অকেজো হয়ে পড়ে, জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। মোট কথা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে জীবন ও সম্পদ বিনষ্টকারী হিসেবে ভূমিকম্প অন্যতম।

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস)-এর মতে, সারা পৃথিবীতে বছরে লাখ লাখ ভূমিকম্প হয়। এর অনেকগুলো হয়তো বোঝাই যায় না। কারণ এসব হয় খুব প্রত্যন্ত এলাকায় অথবা সেগুলোর মাত্রা থাকে খুবই কম। প্রতি বছর গড়ে ১৭টি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়, রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ৭-এর ওপরে এবং ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয় একবার। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৯ মে ১৯৯৭ মধ্যরাতে ইরানে প্রচণ্ড ভূমিকম্পে ৪ হাজারেরও বেশি লোক মারা যায় এবং আহত হয় প্রায় ১০ হাজার লোক, ধ্বংস হয় ২০০টি গ্রাম।

No description available.

জাপানের উত্তর-পূর্বে ২০০৯ সালের ১১ মার্চ একটি বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানে, যার মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৯। এর ফলে পৃথিবীর ভরের বণ্টনে পরিবর্তন ঘটে এবং এর প্রভাবে পৃথিবী ঘুরতে থাকে সামান্য দ্রুতগতিতে। ভূমিকম্পের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো শহর প্রতি বছর গড়ে দুই ইঞ্চি করে লস অ্যাঞ্জেলসের দিকে সরে যাচ্ছে। পৃথিবীতে যত ভূমিকম্প হয়, তার ৯০ শতাংশই হয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জুড়ে। ২০১০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বড় ধরনের এক ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল চিলির কনসেপসিওন শহরে। ঐ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৮। এর ফলে পৃথিবীর শক্ত উপরিভাগে ফাটল ধরে এবং শহরটি ১০ ফুট পশ্চিমে সরে যায়। নেপালে ২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল আঘাত হানে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প। এর ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং হিমালয়ের অনেক পর্বতের উচ্চতা কমে আসে। মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতা তখন এক ইঞ্চির মতো কমে গিয়েছিল।

বাংলাদেশও ভূমিকম্পের ভয়াবহতা থেকে সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত নয়। ‘নেচার জিওসায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। ভূমিকম্পের দিক থেকে বাংলাদেশকে তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জোন হিসেবে উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাচলের কিছু কিছু স্থান যেমন সিলেট, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার উল্লেখযোগ্য। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সর্বাপেক্ষা কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে ভয়াবহ ভূমিকম্পে অনেক ঘরবাড়ি ধ্বংস, অসংখ্য জীবজন্তু ও মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং সর্বোপরি নদীর গতিপথেরও পরিবর্তন হয়েছে।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প অনুভূত

ইতিহাসে দেখা যায়, ১৫৪৮ সালে সিলেট ও চট্টগ্রামে ভূমিকম্পের ফলে বহু স্থানে মাটি দুই ভাগ হয়ে যায়। ১৬৪২ সালে তীব্র ভূমিকম্পে সিলেট জেলায় মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৬৬৩ সালে আসামে সৃষ্ট আধঘণ্টা স্থায়ী এক ভূমিকম্পে সিলেট জেলা প্রকম্পিত হয়। ১৭৬২ সালের ২ এপ্রিল ভূমিকম্পের ফলে চট্টগ্রামের কাছে ১৫৫ দশমিক ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা স্থায়ীভাবে দেবে যায়। ১৭৭৫ সালের ১০ এপ্রিল ঢাকার আশপাশে তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ১৭৮২ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে গঙ্গা নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে। ১৭৮৭ সালে ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথেও পরিবর্তন আসে। ১৮১২ সালের ১১ মে সিলেটে প্রচণ্ড এক ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। ১৮৬৯ সালে সিলেটে এক ভূমিকম্পে কয়েকটি ভবনে ফাটল ধরে এবং বহু নদীর তীর দেবে যায়।

১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভূমিকম্পে সিলেটের বেশ কিছু দালানকোঠার ব্যাপক ক্ষতি হয়। ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই যে ভূমিকম্প (৭ দশমিক ৬ মাত্রা) হয়, তা শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প নামে পরিচিত। ১৯৯৭ সালের ২২ নভেম্বর চট্টগ্রামে সংঘটিত ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৬। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে মহেশখালী দ্বীপে সংঘটিত ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ২। তাছাড়া স্মরণকালের মধ্যে বাংলাদেশে যেসব ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল তার মধ্যে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প, ১৯৩২ সালের উত্তরবঙ্গ ভূমিকম্প, ১৯৩৫ ও ১৯৩৬ সালের মধ্য বাংলার ভূমিকম্প বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে যে প্রলয়ঙ্করী বন্যা হয়, তা ঐ বছরের আগস্টে ভারতের বিহারে সৃষ্ট ভূমিকম্পের জন্য অনেকাংশে দায়ী।

বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট। সম্প্রতি কয়েক দফায় এখানে ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটে। ২৯ মে পরপর চারবার, ৩০ মে একবার এবং ৭ জুন পরপর দুই বারসহ সিলেটে মোট সাত দফা ভূমিকম্প হয়েছে। ২৮ এপ্রিল ২০২১ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হওয়া এ ভূমিকম্পে দুলেছে রাজশাহী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৬ দশমিক ২। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসামে। এর আগে গত ৫ এপ্রিল মৃদু ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা। প্রায় ৮ সেকেন্ড স্থায়ী রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৬।

আবহাওয়াবিদ ও বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, অল্প সময়ে এ ধরনের ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস। তাই সামনের দিনগুলোতে তারা বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন। যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের একদল বিজ্ঞানীর গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেছে, সাড়ে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা শহরে সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪ লাখেরও বেশি ভবন রয়েছে এবং রাজউক এলাকায় রয়েছে ১২ লাখেরও বেশি—যার অধিকাংশই ভূমিকম্প সহনীয় নয়। আর সেজন্য যদি একটা বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়, সেক্ষেত্রে আমাদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাটা সহজেই অনুমেয়। তাদের মতে, ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। আর এ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরে প্রায় ১ লাখ থেকে ২ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটবে।

সিলেটে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২ দফায় ভূমিকম্প

বিজ্ঞান ও গবেষণার উচ্চ শিখরে আরোহণ করেও আমরা প্রকৃতির এ তাণ্ডবলীলা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হয়নি। ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। এটি রোধ করার কোনো উপায় নেই। তাছাড়া ভূমিকম্প সম্পর্কে সঠিক ও নির্ভুল পূর্বাভাস দেওয়ার উপায়ও এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। কাজেই আমাদের দেশে ভূমিকম্পের বিষয়টি অবহেলা না করে ভূমিকম্পের সম্ভাবনাময় স্থানগুলোতে অবশ্যই সক্রিয়ভাবে ভূমিকম্প গবেষণাগার স্থাপন করা উচিত। অন্যদিকে, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করার জন্য বিভিন্ন পুরনো ভবনকে যথোপযোগীভাবে সংস্কার করতে হবে। পাশাপাশি নতুন ভবন নির্মাণ ও বিভিন্ন স্থাপনাকাজে অবশ্যই বিল্ডিং কোড মেনে সঠিক গ্রাউন্ড মোশন নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: কবি ও কলাম লেখক

ইত্তেফাক/এমআর

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন