তামাকপণ্য প্রকৃতপক্ষে মৃত্যূদূত। তামাকজাত পণ্য যেমন বিড়ি, সিগারেট জর্দা-গুল ইত্যাদি মানুষকে নেশায় আসক্ত করে, এমনকি মাদকের দিকে ঠেলে দেয়। একজন সুস্থ সবল মানুষ ধীরে ধীরে অসুস্থ হতে থাকে, এবং অনেকেরই মৃত্যু ঘটে। ধূমপানের কুপ্রভাব গ্রাস করছে পৃথিবী, বিশেষ করে তরুণসমাজ এর বিষাক্ত নেশার কবলে পড়ছে।
বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর প্রাধান ৮টি কারণের মধ্যে ৬টির সাথেই তামাক জড়িত। ধূমপান নিয়ে সারা বিশে^র চিকিৎসক, গবেষক মহলের ভাবনার শেষ নেই, ধূমপান-রিরোধী সচেতনতার লক্ষ্যে ব্যয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এত সেমিনার, প্রচারনা, এত লেখালেখি তবুও তামাকের ব্যবহার বেড়ে চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে তামাকই হবে আগামীদিনের মহামারী। তামাকের এই ভয়াল ক্ষতি প্রতিরোধে ২০০৩ সালে বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) স্বাক্ষরিত হয়।
বাংলাদেশ সরকার জনস্বাস্থ্যের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এফসিটিসি’র আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫ প্রণয়ন করে। ২০১৩ সালে তামাক আইনের গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা প্রণয়ন হয়। এই আইন ও বিধিমালার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হলো পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ, তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা নিষিদ্ধ, অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ, তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্ক বার্তা মুদ্রণ নিশ্চিত করা।
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ণে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। আইনের দূর্বলতাকে পুঁজি করে তামাক কোম্পানিগুলো, তামাক ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুটেই যাচ্ছে। মৃত্যুর কালো ধোঁয়া তারা বাজারজাত করছে আকর্ষণীয় মোড়কে!
তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিধি নিষেধে রয়েছে দুর্বলতা, যা তামাক নিয়ন্ত্রণে বড় বাঁধা, তাছাড়া তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধকরণের ক্ষেত্রেও রয়েছে আইনি দুর্বলতা। তামাক ব্যবহারের সহজলভ্যতা তরুণ সমাজ ও স্বল্প আয়ের মানুষদের ধূমপানের আগ্রহ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এছাড়াও পাবলিক প্লেসে অবাধ ধুমপান শুধু সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোকিংয়ের ভয়াবহতাই ছড়িয়ে দিচ্ছে না, বরং এর প্রভাবে কৌতূহলি হয়ে পড়ছে কিশোর তরুুণরা। ধূমপান এখন শুধু নেশা নয়, অনেকটা ফ্যাশন! ধূমপায়ীদের একটা বড় অংশ অন্যদের দেখে কৌতূহলবশত এই নেশায় জড়িয়ে পড়ছে।
আইনে আছে, কোন ব্যক্তি কোন পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনে ধুমপান করতে পারবে না। বেশকিছু ক্ষেত্রে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধুমপানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যেমন, চার দেওয়ালে আবদ্ধ নয় এমন রেস্তোঁরা, কোন কোন পাবলিক প্লেসে নির্ধারিত এলাকায় ধুমপান, একাধিক কক্ষবিশিষ্ট গনণরিবহন, সবধরনের অযান্ত্রিক পাবলিক পরিবহন ইত্যাদি। আইনের এই নমনীয়তার সুযোগ নিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনিয়ম হচ্ছে। বর্তমানে অনেক হোটেল, রেস্তোরা, কফিশপ ইত্যাদি রয়েছে যেগুলোর চারপাশ দেওয়াল দ্বারা আবদ্ধ নয়।
সেসব জায়গাসহ সকল ধরনের পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও গণপরিবহনে ধূমপানসহ সকল ধরনের তামাক পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি ধূমপানমুক্ত ভবন বলতে সেই ভবনের বারান্দাসহ সকল আচ্ছাদিত স্থানকে অন্তর্ভূক্ত করা জরুরি। কর্মক্ষেত্র, রেস্তোরাসহ পাবলিক প্লেসকে শতভাগ ধূমপানমুক্ত করা গেলে সেখানে আগত অধূমপায়ীদের হৃদরোগের ঝুঁকি ৮৫% পর্যন্ত হ্রাস পারে এবং তামাকের ব্যবহারও নিয়ন্ত্রিত হতে পারে।
ধূমপান নিয়ন্ত্রণে কেবল জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো, অথবা সরকারি-বেসরকারি সংগঠনগুলোর উদ্যোগ যথেষ্ঠ নয়, পাশাপাশি জরুরী আইনের কঠিন প্রয়োগ। জনগণেনর সচেতনতার পাশাপাশি আইন প্রয়োগ এতটাই কার্যকর করতে হবে যাতে কোন শক্তি এই বাধা অতিক্রম করতে না পারে। তাছাড়া তামাক ব্যবসায়ীরা এভাবেই হাতিয়ে নিতে থাকবে টাকার পাহাড় আর অধূমপায়ীরা পরবে ক্ষতির গভীর কূঁপে।
২০১৬ সালে ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় স্পিকার্স সম্মেলনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাক নির্মূল করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি তামাক নিয়ন্ত্রণে বদ্ধপরিকর। এজন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ও এফসিটিসি’র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সংশোধনের ঘোষণাও দেন। বিদ্যমান আইনের দুর্বলতা সংশোধন করেত পারলেই প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তবায়ন সম্ভব, যা জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষতি হ্রাসে ভুমিকা রাখার পাশাপাশি ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ইত্তেফাক/টিআর