শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মশা নিয়ে ভাবনা

আপডেট : ০৩ আগস্ট ২০২১, ১০:২২

জীবনে কোনো কিছুই ক্ষুদ্র নয়, তুচ্ছ নয়। মশার কথাই ধরা যাক। মশা এমনিতে ছোট্ট জীব। কিন্তু এর প্রভাব মোটেও ছোট নয়। মশার কামড় আমাদের জীবনকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। মশার কামড়ে নানা ধরনের রোগ ছড়ায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হওয়ার কারণে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। সেই দিক থেকে এটা পৃথিবীর বিভিন্ন যুদ্ধবাজ দেশ, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের চেয়ে কম ভয়াবহ নয়! প্রতি বছর এই ক্ষুদ্র জীবটি লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে। ম্যালেরিয়া ছাড়াও ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়া, ওয়েস্ট নাইল, ইয়োলো ফেবার ইত্যাদি রোগ মশা ছড়ায়। মশাকে ক্ষুদ্র করে দেখার সুযোগ আছে মশাই? বিশাল ক্ষমতাশালী নমরুদের নাকের ভেতর দিয়ে মস্তিস্কে প্রবেশ করেছিল একটি ক্ষুদ্র ল্যাংড়া মশা!

আপনাকে কি মশা অন্যদের তুলনায় বেশি কামড়ায়? কেন জানেন? | লাইফ স্টাইল News  in Bengali

যে মশা প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করে, সেই মশাকে নিয়ে তুলনামূলকভাবে আলোচনা কিন্তু খুব কম হয়। মশা নিয়ে কাব্য, সাহিত্য, নাটক, সিনেমা তেমন নেই বললেই চলে। হলিউডে উদ্ভট সব কল্পিত প্রাণীকে নিয়ে সিনেমা হয়। যে ডাইনোসর বহু শতাব্দী আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, সেই ডাইনোসরকে নিয়ে ‘জুরাসিক পার্ক’ নির্মিত হয়েছে একাধিক পর্ব। এই সিনেমা অস্কারও জিতেছে। গর্জিলা নামে এক কল্পিত প্রাণীকে নিয়ে নির্মিত সিনেমা সারা দুনিয়ায় কোটি কোটি টাকা ব্যবসায় করেছে। সিনেমা হয়েছে ভ্যাম্পায়ার ও ড্রাকুলা নিয়েও। হলিউড-বলিউডে সিংহ, হাতি, বাঘ, কুকুর, ঘোড়া, সাপ, বেড়াল, এমনকি খরগোশ ও ইঁদুরকে নিয়েও অনেক সিনেমা তৈরি হয়েছে। কিন্তু মশা নিয়ে তেমন কোনো সিনেমা নির্মিত হয়নি। বাংলা সাহিত্যে আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে রচিত ‘রাতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে কোলকাতায় আছি’-এর বাইরে তেমন কোনো স্মরণীয় পদ বা কবিতা গোচরীভূত হয়নি। আসলে আমরা বড় জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছোটখাটো জিনিসের প্রতি নজর দিই না। এতে করে ছোটটার ক্ষতি অনেক বড় হয়ে দেখা দেয়। এখন যেমন আমাদের দেশে অনেক বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু।

কথা আছে, বিপদ একা আসে না। আমাদের জীবনে তো আরো নয়। আমাদের ক্ষেত্রে আপদ-বিপদ-মুসিবদগুলো হাত-ধরাধরি করে আসে। একটা এসে ঠ্যাং ভেঙে দেয়, আরেকটা হাত। তো আরেকটা এসে কোমর ভেঙে দিয়ে যায়। একটু যে কাঁদবেন, তারও উপায় নেই। আরেক বিপদ এসে হয়তো আমাদের থোতা মুখটাই ভোঁতা করে দেয়!

আমাদেরও এখন একের পর এক বিপদ। এমনিতেই আমরা করোনায় হিমশিম খাচ্ছি, প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। ঘরবন্দি জীবনে আমরা অস্থির হয়ে পড়ছি। এর মধ্যেই ব্যাপক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু। যার মূল কারণ মশা। মশা মারার ক্ষেত্রে আমাদের সম্মিলিত উদাসীনতা ও ব্যর্থতার কারণেই এখন ডেঙ্গু নতুন আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে।

মশাকে যতই তুচ্ছ ও অবহেলা করা হোক না কেন, জীবাণু সংক্রমণকারী এই মশাই পৃথিবীতে সবচেয়ে জীবনঘাতী পতঙ্গ। পৃথিবীতে ৩ হাজার ৫০০ প্রজাতির মশা উড়ে বেড়াচ্ছে। এসব মশার শতকরা মাত্র ছয় ভাগ হলো স্ত্রী-মশা এবং এরাই মানুষকে কামড়ায় মানুষের রক্ত খায়। এই ছয় ভাগের অর্ধেক অর্থাত্ মাত্র তিন পার্সেন্ট মশা মানুষের শরীরে রোগজীবাণুর সংক্রমণ ঘটায়। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই তিন ভাগ মশা মেরে সাফ করতে পারলে লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে!

বিজ্ঞানীরা তো বলেই খালাস, কিন্তু মশাটা মারবে কে? মশা মারতে কামান দাগা ছাড়া আমাদের ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়রগণ কিন্তু আর সবই করেছেন। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা নিধনে অনেক উদ্যোগ-আয়োজন, কর্মতত্পরতা, ঢাকাঢোল পেটানো—অনেক কিছুই করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

রাজধানীতে চলছে মানুষ-মশার লড়াই

উল্লেখ্য, একটা সময় পর্যন্ত ঢাকা শহরের ময়লা-আবর্জনা সাফ করা, শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখা, মশা মারা, ফুটপাত থেকে হকারদের উচ্ছেদ করা ইত্যাদি কাজের জন্য ছিল সিটি করপোরেশনের একটা ‘মাথা’। পরবর্তী সময়ে এই কাজগুলোকে সুষ্ঠু, সহজ ও পরিপূর্ণভাবে করার জন্য একটা ‘মাথা’কে অপারেশন করে কেটে দুটি ‘মাথা’ অর্থাত্ দুটি সিটি করপোরেশনের জন্ম দেওয়া হয়েছে। একটি মাথা উত্তর, আরেকটি মাথা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। জন্মের পর থেকেই দুই মেয়রকে দুই মাথা নিয়ে বেশ সক্রিয় হতে দেখা গেছে, বিভিন্ন বিষয়ে মাথা ঘামাতে দেখা গেছে। শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখতে শপথের সঙ্গে নিজেরা হাতে ঝাড়ু নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। এডিস মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করেছেন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র এমন ঘোষণাও দিয়েছিলেন, কোনো বাসাবাড়িতে যদি এডিস মশার ডিম পাওয়া যায়, তাহলে সেই বাসাবাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যদিও পরবর্তী সময়ে এটা জানার সৌভাগ্য হয়নি যে, এডিস মশার ডিম ও প্রজননক্ষেত্র শনাক্ত হওয়ার পর দায়ী করে কজন বাসাবাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

মশা নিধনের ব্যাপারে আওয়াজ যতটা শোনা যায়, ধারাবাহিক কার্যকর উদ্যোগ ততটা দেখা যায় না। এর ভিন্ন কারণ থাকতে পারে। আমাদের মেয়রেরা সম্ভবত স্বামী বিবেকানন্দের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। ক্ষুদ্র হলেও মশারাও তো জীব!

মশাকে ক্ষতিকর হিসেবে না দেখে এর উপকারের দিকগুলো যদি সামনে আনি তাহলে মশা মারার কঠিন ও ‘হিংস্র’ পদক্ষেপ থেকে যে কোনো হূদয়বান মানুষই দূরে সরে যাবে। একবার নিজেকে মশা ভাবুন, আর ফগার মেশিনের অশ্লীল আওয়াজ আর ঝাঁঝালো ধোঁয়ার কথা কল্পনা করুন। কী নির্মভাবেই না মশাকে হত্যা হয়! আরেকভাবে ভাবুন, মশা না থাকলে আমরা হয়তো অলস সময় কাটাতাম, নিজের প্রতি যত্ন নিতাম না। মশার উত্পাত মানেই মশারি টাঙানো কিংবা কয়েল জ্বালানো। আর এই দুটি কাজই চরম অলসতার মুহূর্তে আমাদের কর্মঠ ও স্বাস্থ্যবান হতে সহায়তা করে। আর মশা মারতে হলে বিদ্যুদেবগে যে থাপ্পড় দিতে হয়, এতে আমাদের হাতেরও ব্যায়াম হয়।

টিভি দেখতে দেখতে অনেক সময় ঘুম এসে যায়। এতে মজার কোনো নাটক, টকশো বা সিনেমা মিস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু হঠাত্ মশার কামড় আমাদের এই অসময়ের ঘুম দূর করে। কিছু মশা আছে, যারা উদ্ভিদের কাণ্ডের রস খেয়ে বেঁচে থাকে। এসব মশা উদ্ভিদের পরাগ সংযোগে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিছু মাকড়সা, টিকটিকি, গিরগিটি, ব্যাং, বাদুড়সহ বেশ কিছু প্রাণীর প্রধান খাদ্য এই মশা। তাই জীবজগতের খাদ্যশৃঙ্খলের ওপর মশার প্রভাব রয়েছে।

পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে যেগুলোর ব্যবহার পদ্ধতি আমরা এখনো জানি না। তার মানে এই নয় যে, সেটার কোনো উপকারিতা নেই। উদাহরণস্বরূপ, প্রাচীন যুগে আগুনের ব্যবহার কীভাবে করতে হয়, তা মানুষ জানত না। তখন তাদের কাছে আগুন খুবই ভয়ংকর জিনিস ছিল। কিন্তু তারা যখন আগুনের ব্যবহার শিখল, তখন সমাজ-সভ্যতা দ্রুত পালটে গেল। মশার ইতিবাচক ব্যবহার হয়তো আমরা এখনো জানি না। তার মানে এটা নয় যে, এর কোনো উপকারিতা নেই। হয়তো আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্ম একদিন সেই রহস্য উদ্ভাবন করবে। তখন আমরা ঘরে ঘরে মশার চাষ করব!

কীভাবে মশা থেকে নিজেকে দূরে রাখবেন?

পুনশ্চ:

  • একজন মশাপ্রেমী মশাকে ‘মহান’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তার অবদানের কথা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। তিনি মশার উদ্দেশে রচিত এক ‘মানপত্রে’ লিখেছেন,
  • ৬৪ জেলার অলিগলিতে দাপিয়ে বেড়ানো সম্মানিত মশা, আপনি আছেন বলেই সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন এদের কত কাজ, কত বাজেট! কত মেডিসিন! কত কামান!
  • আপনি আছেন বলেই কত কর্মসংস্থান! কত নিয়োগ, কত টেন্ডার, কত দৌড়াদৌড়ি!
  • আপনি আছেন বলেই মশারি, কয়েল, গুডনাইট, ধুপ, অ্যারোসল, আরো কত কোম্পানি, কত বাণিজ্য!
  • আপনি আছেন বলেই কত নতুন নতুন আবিষ্কার! কত গবেষণা কত অনুসন্ধান!
  • আপনি আছেন বলেই থরে থরে সাজানো দোকানির বস্তুসামগ্রী, কত বেচাকেনা!
  • আপনি আছেন বলেই কত রক্ত টেস্ট! কত চিকিত্সা! কত ওষুধ, কত ক্লিনিক!
  • আপনি আছেন বলেই টিভি-সংবাদপত্রে কত বিজ্ঞাপন! কত টাকার ছড়াছড়ি!
  • আপনি আছেন বলেই অ্যান্ড্রয়েড, আইএসও অথবা মাইক্রোসফটের কত অ্যাপস! কত প্রযুক্তি!
  • আপনি আছেন বলেই বাংলা ভাষায় কত প্রবাদ-প্রবচন! কত সমৃদ্ধি!
  • দুই-এক ফোঁটা রক্ত আপনাকে খেতে দেব না, তাই কি হয়? অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ও জিডিপিতে আপনার এই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদানের জন্য অজস্র ধন্যবাদ

লেখক: রম্যরচয়িতা

ইত্তেফাক/জেডএইচডি

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন