বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মহামারির অন্তর্নিহিত বার্তা

আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮:৩৯

করোনা বিপর্যস্ত বিশ্বে স্বস্তি কবে ফিরে আসবে—এ যেন অন্তহীন জিজ্ঞাসা। এটা পরিষ্কার করার জন্য যে চীন থেকে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর ঘটনাটার পেছনে একটা ঐতিহাসিক প্রস্তুতি ছিল। মারাত্মক এই জীবাণুটি চীনের জৈব রাসায়নিক পরীক্ষাগার থেকে বের হোক আর না-ই হোক, তাদের অধুনা-অবলম্বিত পুঁজিবাদ থেকেই যে সে উৎপন্ন হয়েছে সে ব্যাপারে তো বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ নেই। অধুনা চীন অতি অল্প সময়ে অবিশ্বাস্য রকমের উন্নতি করেছে এটা ঠিক, কিন্তু সেই উন্নতিতে মানবিক মূল্যের দিকটা মনোযোগ পায়নি। জাতীয় সম্পদের বৃদ্ধি ঘটেছে, কিন্তু মানুষের নিরাপত্তা বাড়েনি, উলটো কমেছে। তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে অত্যন্ত উন্নত, এটা প্রমাণ করার জন্য চীনের হাসপাতালে কত মিলিয়ন শয্যা রয়েছে, কত মিলিয়ন পেশাগত চিকিৎসক সে দেশে কাজ করছেন—এসবের পরিসংখ্যান প্রাসঙ্গিক বটে, কিন্তু খুবই জরুরি তো ছিল করোনা ভাইরাসের মতো মানুষ ও মনুষ্যত্ব-ধ্বংসে অভিলাষী জীবাণু যে তলে তলে যুদ্ধ-প্রস্তুতি নিচ্ছে সেটা জানা। জানলে এবং ব্যবস্থা নিলে বিশ্বব্যাপী মানুষের সমস্ত অর্জন আজ এমনভাবে বিপদগ্রস্ত হতো না।

করোনা পরীক্ষার ফি কার জন্য কত

নিকট অতীত থেকে একটা দৃষ্টান্ত দিই। উহানে একটি অস্বাভাবিক রোগের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, এমন খবর সেখানকার একজন চিকিৎসক তার ফেসবুকে লিখেছিলেন। তার কথাকে মোটেই পাত্তা দেওয়া হয়নি। উলটো তাকে ধমকে দেওয়া হয়েছিল গুজব ছড়ানোর দায়ে। চিকিৎসকের সতর্কবাণী বাসি হয়ে ফলেছে এবং ফলবার ঐ প্রক্রিয়াতে চিকিৎসক নিজেও প্রাণ দিয়েছেন। একইভাবে প্রাণ দিয়েছেন ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের একজন বাঙালি চিকিৎসক। ফেসবুকে সেই দেশের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি একটি খোলা চিঠিতে লিখেছিলেন, চিকিৎসকদেরকে যথোপযুক্ত ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যনিরাপত্তার সরঞ্জাম দেওয়া দরকার। তার কথা শোনার আগেই তিনি মারা গেছেন ঐ করোনা রোগেই। তার চিকিৎসক স্ত্রীও আক্রান্ত হয়েছিলেন; তবে প্রাণে বেঁচে আছেন। চীন ও ব্রিটেন দুই দেশ ঠিকই পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বীও, তবে ব্যবস্থা এখন একই।

১০০ বছর আগে স্প্যানিশ ফ্লুর জন্যও কোনো কোনো মহল থেকে চীনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঐ সময়টাতে শ্রমিকের খুব দরকার পড়েছিল। চীনে সস্তা শ্রমিক পাওয়া যেত। চীন থেকে বহু শ্রমিক গিয়েছিল যুদ্ধরত ফ্রান্সে। গিয়েছিল তারা বদ্ধ ট্রাকে চেপে, গাদাগাদি করে। ফ্রান্সে গিয়েছিল নোংরা পরিবেশে। রোগটা তারাই ছড়িয়েছিল বলে একটা মত চালু আছে। ইতিহাসের বক্রাঘাত এখানে যে ১০০ বছর পরে এবার আর সন্দেহ নয়, বাস্তবিকই রোগটা ছড়িয়েছে সেই চীন থেকেই। ১০০ বছরে সভ্যতা অনেক অনেক এগিয়েছে, চীনও আগের সেই দুর্দশার অবস্থায় নেই, তবু রোগের দায়ভার যে তাকেই বহন করতে হলো। তাতে এটাই প্রমাণিত হয়, যা এতক্ষণ বলছিলাম, চীনের উন্নতি মানুষ ও মনুষ্যত্বকে নিরাপদ করেনি।

তবে একসময়ে চীন যে সমাজতন্ত্রী হয়েছিল ও ছিল, সেটা তো মিথ্যা নয়। সমাজতন্ত্রী হওয়ার ঐ অভিজ্ঞতার যা অবশিষ্ট আছে তাই তাকে শক্তি ও সাহস দিয়েছে করোনা পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করার ব্যাপারে। পুঁজিবাদী বিশ্বের তুলনায় মোকাবিলাটা সে ভালোভাবেই করেছে। করোনা চিকিৎসার জন্য সাত দিনের ভেতর উহানে তারা যে রকমের একটা হাসপাতাল তৈরি করে ফেলেছিল, সেটা বাইরের বিশ্বকে রীতিমতো অবাক করেছিল। তারপরে আছে করোনা-সংক্রমণের নিয়ন্ত্রণ। সেটাও এমন দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে, যার তুলনা পুঁজিবাদী দুনিয়ার কোথাও পাওয়া যাবে না। একইভাবে সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতার কারণেই ভিয়েতনামও করোনাকে রুখে দিয়েছে নিজের সীমান্তে। আর কিউবার তো কথাই নেই; তার যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা তা পর্যায়ক্রমিক বহিঃস্থ আক্রমণেও বিপর্যস্ত হয়নি। সমাজতন্ত্রী কিউবা নিজেকে তো রক্ষা করেছেই, আগের মতোই অন্য দেশকেও সাহায্য করেছে। একদা সমাজতন্ত্রী চীনও সাহায্যের জন্য অন্য দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাঠিয়েছে, বাংলাদেশেও এসেছিল একটি টিম। তারপর তারা পাঠিয়েছে উপহারের টিকা। এখন চীন থেকেই কেনা হচ্ছে চাহিদার নিরিখে টিকা।

খাদ্যের খোঁজে জঙ্গল থেকে একটি হাতি এসেছিল ভারতের কেরালা রাজ্যের একটি লোকালয়ে। লোকেরা কয়েক জন হাতিটিকে খুব খাতির করেছিল। খেতে দিয়েছিল। ক্ষুধার্ত হস্তি ভক্ষণ করেছিল—মানুষ যা দিয়েছিল তা-ই। তার পরেই কিন্তু বিস্ফোরণ। খাদ্যের ভেতর লুকানো ছিল বোমা; হাতির দেহাভ্যন্তরে গিয়ে সেটি বিস্ফোরিত হয়েছে। মরা হাতি যে লাখ টাকা, সে তো জানাই ছিল ঐ লোকদের। সেজন্যই এই কর্মসম্পাদন। এটা সেই আচরণেরই অংশ, যার দরুন প্রাণী ও প্রকৃতি আজ বিরূপ হয়েছে এবং প্রকৃতির কাছ থেকে নানা রকমের ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। করোনা ভাইরাস যার একটি। এ বিষয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। যেমন বলতে পারি করোনার স্পিরিটের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। তা করোনার স্পিরিটটা কী? না, সেটা হলো বিচ্ছিন্নতা। করোনা যা বলছে তা হলো বাঁচতে যদি চাও তাহলে যত তাড়াতাড়ি পারো বিচ্ছিন্ন হও; সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখো। এই স্পিরিটের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অর্থ হচ্ছে সামাজিক হওয়া। সামাজিক হওয়াকেই কেউ হয়তো নাম দেবেন মানবিকতা। সে নামকরণ মোটেই অযথার্থ হবে না। সামাজিকতার ভেতরই মানবিকতা থাকে এবং সামাজিকভাবেই মানবিকতা তথা মনুষ্যত্ব বিকশিত হয়। বনের মানুষেরা ঠিক মানুষ নয়, বনমানুষ বটে।

করোনা আক্রান্তরা নেগেটিভ হলেই সুস্থ নয়

কিন্তু সামাজিক হওয়াটা কি সম্ভব হবে? করোনা যা বিগত দেড় বছরের বেশি সময় করেছে, তা তো মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। মানুষ মাত্রেই রোগের জীবাণুবাহী, অতএব জাতশত্রু, এই ধারণা প্রোথিত করে দিতে চাইল মনের গভীরে। করোনা থাকবে না, কিন্তু ধারণাটা? সেটাও চলে যাবে বলে আমরা আশা করব। কিন্তু যাবে না, আর যায়ও যদি চলে তবেও তার দাগটা থাকবে, নদী শেষ হয়ে গেলেও নদীর দাগটা যেমন থাকে। তবে এই দাগ কিছুতেই মুছে যাবে না। কারণ এর ওপর কোনো পলিমাটি জমবে না, বরং পলিমাটি যা পড়তে চাইবে অনুকূল হাওয়াতে তা উড়ে যাবে। তার চেয়েও বড় সত্য হলো এই যে, করোনায় যে বিচ্ছিন্নতা শেখাল, সেটা এসেছে রোগটির জনক-জননী যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, সেখান থেকেই। করোনা কাবু হবে, কিন্তু পুঁজিবাদ মোটেই কাবু হবে না। সে উঠবে আরো মরিয়া হয়ে। অসহায় মানুষদের কেউ কেউ ধর্মের দিকে ঝুঁকবে। বলবে, যা ঘটছে তা মানুষের পাপাচারের ফল, অতএব ধর্মের কাছে যাও। কিছুদিন আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র একটি জাতীয় দৈনিকে পত্র লিখে যে ধরনের আহ্বান জানিয়েছে, তেমন আন্তরিক কিন্তু অর্থহীন কথা শোনা যাবে। তার চিঠির শিরোনাম ‘মানবতা আজ কোথায়? হাসপাতালে রোগীর প্রতি নিষ্ঠুরতা’। চিঠির ভেতরের মূল আহ্বান :‘আসুন, আমরা একটু মানবিক হই। করোনার ভয়ে পালিয়ে বেড়ালেই কি আমরা করোনা থেকে বাঁচতে পারব? না, পারব না। আমরা আপনজনের প্রতি নিষ্ঠুর না হয়ে মানবিক হলে মহান প্রতিপালকও আমাদের প্রতি মানবিক হবেন।’

করোনার নতুন ধরন ‘মিউ’ শনাক্ত, পর্যবেক্ষণ করছে ডব্লিউএইচও

তা তরুণ ছাত্রই-বা শুধু কেন, চিকিত্সকদের একটি সংগঠনও তো দেখলাম তার সদস্যদের প্রতি বিজ্ঞাপন দিয়ে করোনা চিকিত্সায় ব্রতী হতে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিল। বিজ্ঞ মানুষেরা কেউ কেউ বলছেন ‘বাস্তবসম্মত’ কথা। বলছেন করোনা একটা অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ, এর মোকাবিলা করতে হবে। হ্যাঁ, ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত চেষ্টায় বিশ্বের কয়েকটি দেশ টিকা উত্পাদন করেছে। বিভিন্ন দেশে টিকার প্রয়োগও হয়েছে, হচ্ছে। আমরাও টিকা সংগ্রহ করে সেই পথেই। কিন্তু মূল চ্যালেঞ্জটা যেখান থেকে আসছে, সেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মুখোমুখি দাঁড়ানো এবং তাকে বদলানোর কথাটা মোটেই বলছেন না। আর পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য চলছে বলে যারা মানেন তারাও পুঁজিবাদের অগ্রভাগে বিশেষণ যোগ করে তার মুখ্য পরিচয়টাকে জানি না কেন অস্পষ্ট করে রাখতে চান। তাদের কাছ থেকে অবিকশিত পুঁজিবাদ, অনুন্নত পুঁজিবাদ, করপোরেট পুঁজিবাদ, নিও-লিবারেল পুঁজিবাদ, বিকৃত পুঁজিবাদ, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম ইত্যাদির কথা শোনা যায়। প্রতিকার হিসেবে কালচারাল রিফর্ম, ইনক্লুসিভ ডেমোক্র্যাসি, ক্যাপিটালিজম উইথ এ হিউম্যান ফেইস, নব্য উদারতাবাদকে প্রত্যাখ্যান, অ্যাডজাস্টমেন্ট, অ্যাডাপটেশন, এ ধরনের সংস্কারের পথ দেখান। আওয়াজ ওঠে দুর্নীতি দমন চাই। দুর্নীতিবাজদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু মূল ব্যাধির চিকিৎসা তো ওসব ওষুধে নেই, সেটা রয়েছে অস্ত্রোপচারে। অস্ত্রোপচারেও কুলাবে না, চিকিৎসা আছে পুঁজিবাদকে বিদায় করার ভেতরে।

খুলনা বিভাগে মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়ালো

মূল কথা হলো—কোঅপারেশন চাই। কোঅপারেশন চাই নতুন এক আন্তর্জাতিকতা সৃষ্টির জন্য, যেটির চরিত্র দোকানদারির হবে না, হবে মানবিক। যার লক্ষ্য সীমিত থাকবে না, প্রসারিত হয়ে রূপ নেবে বৈপ্লবিক। আর সে বিপ্লবটা হবে পুঁজিবাদকে উচ্ছেদ করে ব্যক্তিমালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার। দরকার রাষ্ট্রের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, যার অর্থ দাঁড়াবে বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলে ক্ষমতার পরিপূর্ণ বিকেন্দ্রীকরণ এবং নাগরিকদের ভেতর অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রত্যেকটি নাগরিককে সব রকমের নিরাপত্তা দেওয়া। বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রগুলো যদি ঐ রকমের হতো, তাহলে করোনা ভাইরাসের আক্রমণটাই ঘটত না। অঙ্কুরেই সে মারা পড়ত।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ইত্তেফাক/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন