শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

অনুভব শক্তির আলোয় জ্ঞান

আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:২৭

মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্যের প্রশ্নে বলা হয়ে থাকে মানুষের যুক্তিসম্পন্নতা (Rationality) তাকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা মর্যাদা দেয়। অনুভব ও চিন্তাশক্তি মানুষকে যুক্তিসম্পন্ন প্রাণী বানাবার প্রধান চালিকা শক্তি। যদিও অনুভবশক্তি ও চিন্তাশক্তি এক নয়, তারা পরস্পরকে উসকে দিয়ে একে অপরের ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। একজন মানুষ তার চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন অনুভবের জগতে প্রবেশ করে নতুন অনুভূতির আস্বাদ পেতে পারে। আবার সেই মানুষই নতুন কোনো অনুভূতির মধ্যে ডুবে গিয়ে নতুন চিন্তায় মগ্ন হয়ে যেতে পারে।

চিন্তা ও অনুভবশক্তি ছাড়া মানুষের যুক্তিসম্পন্নতার উদ্ভব হতো কি না, সে ব্যাপারে সংশয় আছে। চিন্তা ও অনুভব শক্তি ছাড়াও হয়তো মানুষ জ্ঞান লাভ করতে পারত, কিন্তু সে জ্ঞান অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষকে তেমন একটা পৃথক করতে পারত না। সুতরাং যুক্তিশক্তি ও জ্ঞানশক্তির তুলনায় চিন্তাশক্তি ও অনুভবশক্তি মানুষের স্বতন্ত্র পরিচয় নির্ণয়ে অগ্রাধিকার পাবে—এ দাবি করা যেতে পারে। মানুষের মধ্যে তথ্য ঢুকিয়ে দিলেই তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্লেষিত হয়ে বেরিয়ে আসবে না। তাকে চিন্তা ও অনুভবশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সে তথ্যকে বিশ্লেষণ করতে হয়। এখানেই কম্পিউটারের সঙ্গে মানুষের প্রধান পার্থক্য। কম্পিউটারের যুক্তি-বিশ্লেষণ ক্ষমতা আছে, তাতে তথ্য ইনপুট হিসেবে ঢুকিয়ে দিলে আউটপুট বেরিয়ে আসে। অত্যাধুনিক কম্পিউটার সুর সৃষ্টি করতে পারে, ছবি আঁকতে পারে, এমনকি তা কবিতা লিখতে পারার মতো জাদুকরি শক্তি প্রদর্শন করেছে। কিন্তু কম্পিউটার যত দিন না অনুভবশক্তি অর্জন করছে, তত দিন সে সৃজনশীলতার প্রতিযোগিতায় মানুষের চেয়ে পিছিয়ে থাকবে সুনিশ্চিত।

অক্ষর ব্লগ

অনুভবশক্তি ও জ্ঞানশক্তির তুলনামূলক আলোচনায় বলা যায়, অনুভবশক্তি ব্যতীত জ্ঞানশক্তির গুরুত্ব সামান্যই। তথ্য-বিশ্লেষণের কাজে না লাগলে যেমন তথ্যপঞ্জিকার গুরুত্ব সামান্যই। ভাষার উত্কর্ষসাধনে কাজে না লাগলে শব্দাভিধানের গুরুত্ব আর কতই-বা অবশিষ্ট থাকে। অনুভব-ক্ষমতার মধ্য দিয়ে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হয়, জ্ঞানের ক্রমবৃদ্ধি ঘটে এবং জ্ঞান নতুন মাত্রা লাভ করে যেখানে তথ্য-উপাত্তের ভূমিকা পাঠ-সহায়ক শব্দকোষের মতো। অনুভবহীন, চিন্তাহীন জ্ঞান তাই নির্জীব নিষ্প্রাণ সীমাবদ্ধ চৌহদ্দির ভেতর কোনো বন্দির মতো মুক্তির অপেক্ষায় ছটফট করতে থাকে।

‘জ্ঞান’-এর ইংরেজি ‘Knowledge’ শব্দটির উত্পত্তি কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে। সংস্কৃত ‘জ্ঞান’ শব্দটি বিবর্তিত হয়েছে সংস্কৃত ‘যিনা’ শব্দ থেকে। এই ‘যিনা’ থেকে ল্যাতিন কিনো (Keno) শব্দের উত্পত্তি। ল্যাতিন Keno থেকে আধুনিক ইংরেজি ক্রিয়া Know-এর উত্পত্তি। আর Know থেকেই এসেছে Knowledge শব্দটি। Knowledge বলতে প্রাথমিকভাবে ‘To know’ বোঝায় অর্থাত্ ‘জানা’। এতএব ‘জানা’কে জ্ঞানের একটি অন্যতম উপাদান ধরতে পারি এবং এক্ষেত্রে ‘জানা’কে জ্ঞানের সমার্থকও ধরা যেতে পারে। এখন কথা হলো, ‘অনুভব’ করতে হলে মানুষের যে বিশেষ পরিবেশ-পরিস্থিতি ও মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন, ‘জানতে’ ততটা প্রয়োজন হয় না। কোনো রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে যানজটের সময় গাড়িতে বসে কেউ একটি নিবন্ধ পড়ে ‘জানতে’ পারেন বা ‘জ্ঞান’ অর্জন করতে পারেন। কিন্তু সেই ব্যক্তি ঐ অবস্থায় একটি বর্ষণমুখর সন্ধ্যা পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারবেন না। এমনকি নিবন্ধের পরিবর্তে যদি কোনো বর্ষাভিত্তিক গল্প-কবিতাও পড়েন, তিনি বর্ষণমুখর সন্ধ্যাটিকে ঐ অবস্থায় শতভাগ অনুভব করতে পারবেন না। এখানেই জ্ঞান ও অনুভবের প্রধান পার্থক্য।

ধর্মীয় জ্ঞানের সঙ্গে প্রযুক্তি জ্ঞান জরুরি

কোনো কোনো কবি-সাহিত্যিক সমালোচকদের হেয় জ্ঞান করেন। তারা হয়তো জানেন না, সমালোচনা কতটা সৃজনশীল ও চিন্তাশক্তিনির্ভর হতে পারে। ভুল ধরার প্রবণতা থেকে সমালোচক সত্তার উদ্ভব। তারা বলেন, ভুল ধরা নাকি সহজ। অথচ তারা হয়তো এ-ও জানেন না ভুল ধরার জন্য জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, অনুভবশক্তি থাকা আবশ্যক। কেউ যদি বলেন, ‘আপনি গরমের দিনে ফুলহাতা শার্ট পরে ভুল করেছেন’ অথবা যদি বলেন, ‘এই তীব্র শীতে হুডি জ্যাকেট না পরে ভুল করেছেন’, তবে সে ধরনের ছোটখাটো ভুল ধরা হয়তো সহজ। কিন্তু সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শনের রাজ্যে ভুল ধরা বেশ কঠিন বটে। বাংলাদেশে বসে ইউরোপীয় নাগরিকদের ভুল ধরা যত সহজ, বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশি নাগরিকদের ভুল ধরা তত সহজ নয়। মানুষ যখন তার চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তখন তার সমালোচনা করা তার জন্য কঠিন হয়ে যায়। অভ্যস্ততা মানুষের অনুভবশক্তিকে কমিয়ে দেয়। আর অনুভবশক্তির ঘাটতির কারণে মানুষ অপরের সমালোচনা যত সহজে করতে পারে আত্মসমালোচনা তত সহজে করতে পারে না। একজন ধূমপায়ী সাধারণত জানেন ধূমপান তার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু ধূমপান হতে তিনি নিজেকে তত দিন বিরত রাখবেন না যত দিন তিনি তার জানা বা জ্ঞানকে অনুভবশক্তির মাধ্যমে মনে-প্রাণে উপলব্ধি করতে পারবেন। অনুভবশক্তিতে দুর্বল জ্ঞানী লোক অনেকটা লাইব্রেরির তাকে সাজিয়ে রাখা জ্ঞানগর্ভ বইয়ের মতো।

লেখক: সাহিত্যিক

ইত্তেফাক/কেকে

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন