শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

জাতি গড়তে চাই সুস্থ মস্তিষ্ক

আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২১, ১০:০৩

মানুষ সৃষ্টিকর্তার অনন্য সাধারণ সৃষ্টি। মানুষকে সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির সেরা জীবের মর্যাদা দিয়েছেন। কিন্তু উপলব্ধির অভাবে আমরা বাঙালিরা নিজেদেরকে হীন, অনগ্রসর ও অনুন্নত জাতি হিসেবে ভাবতে পছন্দ করি।

ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জাতি হিসেবে আমরা ১৭৫৭ সালের আগে পৃথিবীর অর্থনীতিতে ছিলাম অষ্টম। সভ্যতার বিচারে আমরা গাঙ্গেয় অববাহিকার সুপ্রাচীন সভ্যতার একটি। আমাদের মসলিন কাপড় পৃথিবীব্যাপী রপ্তানি হতো। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের সূচনা হলেও মসলিনের মতো সূক্ষ্ম মিহি বস্ত্র তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তাই তো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সমস্ত মসলিন তাঁতির বুুড়ো আঙুল কেটে ফেলার মতো নৃশংস সিদ্ধান্ত নেয় ঔপনিবেশিক শক্তি। ইতিহাস বলে, পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু ভারতবর্ষেই অবস্থিত।

প্রায় ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের রেশ আমাদের মধ্যে একধরনের হীনম্মন্যতার সৃষ্টি করেছে, যা আমাদেরকে ভাবতে শিখিয়েছে ইংরেজদের যা কিছু আছে সবই শ্রেষ্ঠ। আসলে শক্তির উৎস শরীর নয় মস্তিষ্ক। সার্কাসের হাতিকে পোষ মানানোর জন্য বাচ্চা হাতি বন থেকে ধরে এনে পায়ে শিকল দিয়ে হাতিকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়।

বাচ্চা হাতি যখন শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে তখন তার পায়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, ক্ষত সত্ত্বেও মুক্তির চেষ্টা করলে ব্যথায় প্রাণীটি কুঁকড়ে যায়। ফলে সে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা বন্ধ করে। তার মাথায় বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় যে, ছুটতে গেলেই ব্যথা লাগবে। ধীরে ধীরে হাতি বড় হয়। ছোট সময়ের তুলনায় তার শক্তি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়, বাঁধন ছেঁড়া তার জন্য কঠিন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু শিকল টানলে যে ব্যথা লাগে এই স্মৃতি তার মস্তিষ্কে রয়ে গেছে। ফলে সে মুক্ত হওয়ার কোনো চেষ্টাই করে না।

ইংরেজরা প্রায় ২০০ বছর রাজত্ব করেছে। একটি ইংরেজ রেস্টুরেন্টও কিন্তু বাংলায় গড়ে ওঠেনি। একটু দৃষ্টি প্রসারিত করলেই দেখবেন ভারতবর্ষের প্রায় ৩০ হাজার রেস্টুরেন্ট রয়েছে ইংল্যান্ড জুড়ে। এটি প্রমাণ করে যে, খাদ্য উপকরণ তৈরিতে আমরাই শ্রেষ্ঠ ছিলাম। শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই আমরা আমাদের রসনা বিলাসকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পেরেছি।

এই কথাগুলো লিখলাম জাতি হিসেবে নিজেদের সক্ষমতাগুলোকে তুলে ধরার জন্য। আমরা প্রত্যেকটা মানুষই কিন্তু অনন্য। কোটি কোটি শুক্রাণুর মধ্যে একটি মাত্র শুক্রাণু ডিম্বাণুর সঙ্গে নিষেক প্রক্রিয়ায় আমাদের জীবনের সৃষ্টি। সুতরাং, বুঝতে হবে কোটি শুক্রাণুর মধ্যে সবচাইতে শক্তিশালী, উজ্জীবিত এবং প্রাণশক্তিতে ভরপুর শুক্রাণু থেকে জীবন্ত মানুষটির জন্ম। তাই এই মানুষটিকে দিয়ে পৃথিবীর যে কোনো অসাধ্য সাধন করা সম্ভব।

বিশাল জনসংখ্যার দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। যদি আইনের শাসন থাকে এবং প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক হয় সুস্থ ও সবল, তাহলে জনসংখ্যা জনসম্পদে পরিণত হয়। কিন্তু জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় কিছু খবর আমাকে উদ্বিগ্ন করে। যেমন, ‘মাদক কারবারির ছুরির আঘাতে প্রাণ গেল এএসআই-এর’, ‘নেশা থেকে নতুন প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী’, ‘মাদকমুক্ত রাজনীতি গড়ে তুলতে হবে: বাহাউদ্দিন নাসিম’। আমার মতে, খবরগুলো মাদকের অপ্রতিরোধ্য বিস্তৃতির কারণে বিশিষ্টজনদের উদ্বিগ্নতার বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে সমগ্র জাতি আজ উদ্বিগ্ন। মাদকের আগ্রাসন আমাদের বিচারবুদ্ধি কাণ্ডজ্ঞানহীন, মস্তিষ্কবিহীন অবয়বসর্বস্ব জাতিতে পরিণত করছে। সময় এসেছে সমাজ, রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান তথা পারিবারিক পরিমণ্ডল মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চীনের আফিম যুদ্ধের ইতিহাস জানতে হবে। তাহলেই নীরব যুদ্ধের অনুপ্রেরণা প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে সঞ্চারিত হবে।

১৭৭৬ সাল, অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগ। এই সময় ইংল্যান্ডসহ ইউরোপে শুরু হয়েছে শিল্পবিপ্লব। ক্রমেই তা শক্ত ভিত্তি তৈরি করে বিস্তৃত হচ্ছিল। ইউরোপে যখন শিল্পবিপ্লবের যাত্রা জোরদার হচ্ছে তখনও চীন প্রবল অর্থনৈতিক শক্তি।

বিশাল ভূখণ্ডের অধিকারী চীন দেশের দিকে নজর যায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির। তখনকার চীন সম্রাটের দক্ষ শাসনব্যবস্থা ও চীনের বিশাল জনসংখ্যা চীনের প্রতি পশ্চিমাদের আগ্রাসনের ইচ্ছাকে প্রশমিত করে। কিন্তু চীন দেশের বাণিজ্য সম্ভাবনা ও চীনের নৌবন্দর ব্যবহারের লিপ্সা ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে থেকেই যায়। তাই তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তারা কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। পশ্চিমারা চীনের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে মাদকাসক্ত করার মাধ্যমে চীন দেশের অর্থনৈতিক শক্তি, যুবসমাজের সাহস ও নৈতিকতার অটুট বন্ধনকে বিনষ্ট করার ঘৃণ্য চক্রান্ত করে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা চীনে আফিম চোরাচালান শুরু করে। তত্কালীন ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদী শাসনের অন্তর্ভুক্ত একটি পরাধীন ভূখণ্ড। এখানে উত্পাদিত আফিম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সহযোগিতায় চোরাচালানের মাধ্যমে চীনে প্রেরণ করা হতো।

একপর্যায়ে দেখা গেল কোয়াংটুং ও ফুকিয়েন প্রদেশে ১০ জনের ৯ জনই আফিমে আসক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম দিকে চীনারা চা, রেশম, চীনামাটির বাসন ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রী দিয়ে বিদেশি বণিকদের কাছ থেকে আফিম ক্রয় করত। কিন্তু আফিমের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় পণ্য দিয়ে আফিমের দাম পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে তারা রৌপ্যমুদ্রা দিয়ে আফিম ক্রয় শুরু করে। চীনা রৌপ্যের ভাণ্ডার বিদেশে চলে যেতে শুরু করে। শুরু হয় চরম অর্থনৈতিক সংকট। এমন পরিস্থিতিতে চীনের মাঞ্চু সরকার আফিমের চোরাচালান বন্ধের চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিলেন।

সরকার চিয়াচিং ক্যান্টন বন্দরে একজন যোগ্য দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা লিনসেচুকে নিয়োগ দেন। নিজেদের জনগণের মঙ্গল চিন্তায় চীন যখন আফিম চোলাচালনের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করল তখন ব্রিটিশরা আফিম ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার জন্য চীন আক্রমণ করল। চীন সেই যুদ্ধে হারলেও চীনের নৈতিক বিজয় ঘটে। চীনের আপামর জনসাধারণ আফিমের কুফল অনুধাবন করতে পারে এবং বিদেশিদের কুচক্রের নীলনকশা তাদের সামনে উন্মোচিত হয়।

চীনের আফিম যুগের ইতিহাস থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট তা হলো, মাদক কীভাবে একটি পরাক্রমশালী দেশ ও জাতিকে বিনষ্ট করে। ইতিহাসটি বিস্তারিতভাবে স্কুল এবং কলেজের পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। এতে আমাদের নবপ্রজন্মের মনে মাদকের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ভাবনা তৈরি হবেই। চীন আজকে ব্যবসাবাণিজ্য, শিক্ষা, গবেষণা ও জ্ঞানে অন্যতম-এর কারণ মাদক নিয়ন্ত্রণে চীনের সফল উদ্যোগ। মাদকের বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন আইনের সফল প্রয়োগ।

আমরাও যদি মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারি তবেই গড়ে উঠবে ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ আর ২১০০ সালে সমৃদ্ধ বদ্বীপ। কারণ, জাতি গড়তে শুধু অবয়ব নয় চাই মস্তিষ্ক।

লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

ইত্তেফাক/এএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন