শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

মহাকাশ স্টেশনে নারী ও প্রবাসে ক্রিকেট

আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২১, ১০:০৬

সেই কবে, মহাশূন্যফেরত তরুণী, তখনো বিবাহিতা নন, ভালেন্তিনা তেরেশকোভার প্রেমে পড়েছিল পৃথিবী, ভালোবেসেছিল। ভালেন্তিনা দুঃসাহসিকই ছিলেন বটে! একা একা মহাশূন্য ঘুরতে গিয়েছিলেন।

শুধু পুরুষগোষ্ঠী কি ভালেন্তিনাকে ভালোবেসেছিল? অ-নে-ক বছর বাদে, স্পেস-শাটলের যুগে ‘মা-নভচারিণী’ অ্যানা লি ফিশার পৃথিবীর বাড়িতে কন্যাকে রেখে মহাশূন্যে চলে যান কী সব গবেষণা করতে; ঘুরেটুরে ফিরে আসেন পৃথিবীতে। পৃথিবীর মানুষ অ্যানার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, ভালোবাসে।

নারীর আকর্ষণ, পুরুষের আকর্ষণ, ফেমিনিটি ম্যাসকুলিনিটি মানুষের চেতনায় সাড়া জাগায়। এই গুণাবলিকে জনপ্রিয় করে গণমাধ্যম, বিশেষ করে সিনেমাটোগ্রাফি তুলনাহীন ভূমিকা নেয়। ফলে সোফিয়া লরেন, বিবি, এলিজাবেথ টেলার, ক্যাথরিন ডেন্যুভ, র্যাকুয়েল ওয়েলচ, মার্লোন ব্রান্ডো, রিচার্ড বার্টন, গ্রেগরি পেক, ওমর শরিফদের প্রতি বৈশ্বিক আকর্ষণ ও ভালোবাসা বোধের সৃষ্টি হয়।

এ দুই বাস্তব নারীর মধ্যবর্তী সময়ে ‘এইলিয়েনস’-এ (সিরিজ ফিল্ম) হলিউডের মহাশূন্য অভিযানের রিয়ালিস্টিক সেটিংয়ে লেফটেন্যান্ট এলেন রিপলি ওরফে ‘বাস্তব’ সিগোরনি উইভারকে আমরা পাই। অজস্র ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রচুর নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতাকে মোকাবিলা করেন লেফটেন্যান্ট রিপলি। ফলে সিগোরনি উইভার সায়েন্স ফিকশনের বীর নারীতে পরিণত হন। হন ‘গ্রাউন্ডব্রেকার’। টাফ সিগোরনি উইভার, ‘মা নভচারিণী’ অ্যানা ফিশার, তরুণী সিঙ্গল ভালেন্তিনা—তিন নারী, এক আকর্ষণ, ভালোবাসা।

এবারে মহাশূন্য-মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে ইউলিয়া পেরেসিল্ডয়ের। কে এই ইউলিয়া? ব্যক্তিগত জীবনে এক কন্যাসন্তানের মা। পেশাগতভাবে রুশ রুপালি পর্দার নামিদামি অভিনেত্রী এবং টিভি পার্সোন্যালিটি। একেবারে নিভের্জাল অসামরিক ব্যক্তি! এই ইউলিয়া এবং ফিল্ম প্রডিউসার ক্লিম শিপেনকো ঝানু নভচর আন্তন শ্কাপলেরভকে (Anton Shkaplerov) নিয়ে সয়ুজ ক্যাপসুলে চেপে তিন ঘণ্টার মধ্যে সোজা চলে যান আন্তর্জাতিক মহাশূন্য স্টেশনে (আইএসএস)।

অবশ্য আইএসএসে এসে দেখেন যে অটোমেটিক ডকিং কাজ করছে না; তাই শ্কাপলেরভকে হাতেকলমে ‘হ্যাচ’ খোলায় নামতে হয়। চিরন্তন নারী মহাশূন্যের ‘নন-জিরো’ অভিকর্ষের মধ্যে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে কি? পারে না। (রুশ স্পেস এজেন্সি) ‘রসকসমোসের’ লাইভ প্রোগ্রামে দেখা গেল যে ইউলিয়া শ্কাপলেরভকে বেশ সাহায্য করছেন! বাহ্..! রাঁধুনি মেয়ে যে চুলও বাঁধে!

আচ্ছা, বাস্তবিকই কি অটোমেটিক ডকিং বিগড়েছিল? মহাশূন্যে ইউলিয়া গেছেন ‘চ্যালেঞ্জ’ নামক ফিচার-ফিকশন ফিল্মের শুটিং করতে! হূদেরাগের ডাক্তার হিসেবে তাকে পড়ি কি মরি আন্তর্জাতিক মহাশূন্য স্টেশনে যেতে হবে হূদেরাগে আক্রান্ত এক নভচরকে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারার মতো ‘ফিট’ করতে। যা হোক, মহাশূন্যে শুটিং হওয়া প্রথম ফিল্মও হবে একটি চ্যালেঞ্জ। ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ারে অটোমেটিক ডকিং রহস্যের মীমাংসা পাব হয়তো!

এরই মধ্যে ‘স্টার ট্রেকের’ ক্যাপ্টেন জেমস টি কার্ক ওরফে উইলিয়াম শ্যাটনার সারা জীবন পৃথিবীর সেটিংয়ে মহাজগতে বিচরণ করেছেন, ৯০ বছর বয়সে সত্যিকারের মহাশূন্যে গেছেন ঘুরতে। তিনি এটা ডিজার্ভ করেন। ‘মিশন ইমপসিবল’-এর টম ক্রুজও আন্তর্জাতিক মহাশূন্য স্টেশনে শুটিং করতে যাবেন! ইউলিয়া আর টম ক্রুজ জুটি হবে নাকি? একদিন?

‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ নীতিতে জেফ বেজোজ/ইলন মাস্কের যাত্রীরা মহাশূন্যে গেছেন, যাবেন। কিন্তু কোথায় আমাদের আকর্ষণ, ভালোবাসা? চীনা তাইকোনট ‘ওয়াং ইয়াপিং’, সঙ্গী দুই নভচরকে নিয়ে ‘তিয়াংগং’ মহাশূন্য স্টেশনে গেছেন। তিয়াংগংয়ে প্রথম নারী প্রবেশ হলো; ওয়াং সেখানে ছয় মাস থাকবেন; পাঁচ বছরের কন্যাকে বলেছেন, তোর জন্য সেখান থেকে ‘তারা’ নিয়ে আসব।

টানা ১৫৯ দিন আন্তর্জাতিক মহাশূন্য স্টেশন থেকে আসা ক্যাথরিন কোউলম্যান ওয়াংকে বলেছেন, ‘তিয়াংগং’-এর জানালা দিয়ে তুমি যখন নক্ষত্র ও পৃথিবীকে দেখবে, সেই জানালা দিয়ে তোমার সঙ্গে পৃথিবীর কোটি কোটি নারীও দেখবে! শুধু কি নারীই দেখবে?

ওহ! ‘টাইগার’!!

বনের রাজা সিংহ; কিন্তু আসল স্মার্টনেসে মুগ্ধ হয়ে আমরা বলি ‘ব্যক্তিটি’ বাঘের বাচ্চা, বাঘ অথবা টাইগার। যেমন :ক্রিকেট-প্রতিভা মনসুর আলি খান পাতৌদি। একুশ বছর বয়সে ভারতীয় ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন হন; ক্রিকেটে ম্যাসকুলিনিটি মিশ্রিত মাধুর্য, সৌন্দর্য নিয়ে আসেন তিনি।

পাতৌদির ক্রিকেট-কাব্যে মুগ্ধ বিবিসির ক্রিকেট কমেনটেটর জন আরলট তাকে ‘বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ফিল্ডার’ বলেছিলেন। তার সমসাময়িক ইংলিশ দলের ক্যাপ্টেন টেড ডেক্সটারও তা-ই বলেছিলেন। ফলে ক্রিকেট-কাব্যিক এম এ কে পাতৌদি হয়ে যান ‘টাইগার পাতৌদি’। অর্জুন পুরস্কারে ভূষিত ‘টাইগার’কে সম্মান দেখাতে ‘বিসিসিআই’য়ের উদ্যোগে আয়োজিত মেমোরিয়াল লেকচারের উদ্বোধনী লেকচার দিয়েছিলেন ক্রিকেট লিজেন্ড সুনীল গাভাস্কার।

আধুনিক কালের ক্রিকেট জগতের দ্বিতীয় ‘টাইগার’ হলো একটি পুরো জাতীয় ক্রিকেট দল; এককালের ‘মিঠাপানির নানা জাতের ছোট্ট মাছের দল’ লেবেল পাওয়া দলটি এখন দ্য টাইগারস। বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দল। দলটির প্রতি আমাদের আকর্ষণ, ভালোবাসা অম্লান থাকুক!

ক্রিকেট বিশ্বায়িত হয়ে কন্টিনেন্টাল ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছে বেশ আগেই। ‘টাইগার’ নামে নয়, ওদের কোনো কোনো দলের আকর্ষণ ‘সিংহে’র প্রতি, তা থাকুক; কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি ওদের প্রফেশনাল অনুভূতি আমাদের আকর্ষণ করে, ভালো না বেসে উপায় নেই! যেমন :‘প্রাগ টাইগারস ক্রিকেট ক্লাব’; এর মধ্যেই ক্লাবটি চেক ক্রিকেট ইউনিয়নের সদস্য হয়েছে। নবীন বটে, কিন্তু অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে ‘বিডি রিইউনিয়ন কাপ প্রাগ ২০২১’ ম্যাচের আয়োজন করেছিল ক্লাবটি। ম্যাচ খেলতে জার্মানি থেকে দুটো ক্রিকেট দল এসেছিল।

অর্থাৎ ম্যাচটি ছিল আন্তঃদেশীয়। প্রাগের প্রফেশনাল ক্রিকেট উদ্যান ‘ক্রিকেট ভিনোরজ’ (Kriket Vino)-এ ম্যাচ খেলা হয়। প্রাগ টাইগারসের পরিপাটিভাবে এই কর্মকাণ্ড সম্পন্নের ব্যাকগ্রাউন্ডে স্পনসর হিসেবে যে ‘কারি-হাউজ’ ছিল, তাকে করতালিমুখর ধন্যবাদ দিতে হয়। ধন্যবাদ! চেক ক্রিকেট ইউনিয়নের সিইও টেরি ও’কন্নরের হাত থেকে ম্যাচের সবচেয়ে বড়ো কাপটি নেয় ‘টাইগারস আম মাইন’ (নীল জার্সি)। রানারসআপ প্রাগ টাইগারস (সবুজ জার্সি); ‘ক্রিকেট হামবুর্গ বিডি’ শূন্য হাতে ফিরে গেছে, তবে ভবিষ্যতে ঠিকই তাক লাগিয়ে দেবে!

(চেক রিপাবলিক থেকে)

লেখক: বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক

ইত্তেফক/এএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন