শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

কোথায় যেন গলদ রয়েই গেছে

আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২১, ০৬:০১

আমরা প্রায়ই অমুসলিম সম্প্রদায়ের সম্পর্কে বলতে গিয়ে সংখ্যালঘু শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। সেসব সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃত বা অবচেতন মনে তাদেরকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, তারা সংখ্যায় কম। তাই তাদের প্রতি উদার আচরণ করা প্রয়োজন।

একজন মানুষকে তার কষ্টের কথাটি বারবার মনে করিয়ে দিয়ে সহানুভূতি দেখালে যেমন হয়, ব্যাপারটি ঠিক তেমনই। একটি গণতান্ত্রিক সভ্য রাষ্ট্রে সাংবিধানিক চেতনা অনুসারে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু বলে কোনো সম্প্রদায় থাকতে পারে না—সবাই রাষ্ট্রের নাগরিক। আর ধর্ম বা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে কোনো রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিক উদার বা সহানুভূতিশীল আচরণ আশা করে না, আশা করে সমান আচরণ।

আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু ভাবনার বিষয়টি আরো অবান্তর। কেননা, বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। কাজেই বাংলাদেশে যদি সংখ্যালঘু বলে কোনো গোষ্ঠী থেকে থাকে, তারা অনিবার্যভাবেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী অংশ। কিছু লোক এখনো নিজেদেরকে পাকিস্তানি সংস্কৃতির ধারক ভাবতে পছন্দ করে। তাদের মনের মধ্যে এখনো পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দর্শন বিরাজমান। এখনো তাদের চিন্তা-দর্শন আর রাজনৈতিক অস্তিত্বের রসদ আসে পাকিস্তান থেকে।

সংজ্ঞা অনুসারে কোনো রাষ্ট্রের একটি ছোট অংশ, যারা জাতি বা ধর্ম বা রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে অন্যদের থেকে আলাদা তারা সংখ্যালঘু। এ দেশে জাতি হিসেবে আমরা সবাই বাঙালি, এদেশের অধিকাংশ জনগণই ধর্মীয় ভাবনার ক্ষেত্রে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষই বাঙালিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দর্শনে বিশ্বাসী।

বিপরীতে, অল্প কিছু মানুষ এখনো ধর্ম বলতে পাকিস্তানি উগ্র মৌলবাদকে লালন করে; সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পাকিস্তানি সংস্কৃতি অনুসরণ করে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তারা সংখ্যায় খুব বেশি নয়। কাজেই এদেশে এরাই সংখ্যালঘু। এরা পরাজিত শক্তি, তাই উগ্র। এরা হীনম্মন্য, তাই প্রতিশোধপরায়ণ। এদের লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট। তাই তাই সংগঠিত। এরা অন্যের ওপর ভর করে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলে।

ব্রিটিশ শাসনামলে প্রথম ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়। এটি ছিল ভারতবাসীকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্তিকরণের প্রথম আইনগত পদক্ষেপ। ব্রিটিশরা ভারতের অধিবাসীদের এভাবে হিন্দু ও মুসলিমে বিভক্ত করে হাজার বছরের ঐক্যবদ্ধ ভারতকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিভক্ত করে ফেলে। এটি তারা করতে চেয়েছিল হিন্দু-মুসলিমে বিভক্ত করে এক সম্প্রদায়কে অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লাগিয়ে রেখে নিশ্চিন্তে ভারতবর্ষকে শাসন ও শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য। ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য সফল হয় বটে; কিন্তু তাদের গৃহীত নীতির ফলে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও খুবই সূক্ষ্মভাবে পূর্ব বাংলায় এই নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চাইল বাঙালিকে হিন্দু ও মুসলমানে বিভক্ত করার মাধ্যমে। পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায়ের জন্য ৭২টি আসন সংরক্ষিত রাখা হয়। এ সময় হিন্দু জনগোষ্ঠীর পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তে যুক্তনির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি উপেক্ষিত হয়।

১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রণয়নের সময়ও হিন্দু নেতৃবৃন্দ পৃথক নির্বাচনি ব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতা করে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়ে একটি জাতি গঠনের দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও পৃথক নির্বাচন নীতির তীব্র বিরোধী ছিলেন। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলেও ‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায়ের দাবির অনুকূলে যৌথ নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দীর্ঘ নয় বছর পর ১৯৫৬ সালে যে সংবিধান রচিত হয়, তাতে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের ধারা সংযুক্ত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক নীতি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করে।

পাকিস্তান রাষ্ট্রে সংবিধান প্রণয়ন বিতর্ক চলাকালে যখন বলা হয়েছিল—‘দ্য বেস্ট গ্যারান্টি অব মাইনরিটি’স রাইট ইজ দ্য গুড উইল অব মেজরিটি’ অথবা, ‘হিন্দু শুড বি ট্রু টু হিন্দুস্তান অ্যান্ড মুসলিম শুড বি ট্রু টু হিজ রিলিজিওন’—তখন হিন্দুরা পাকিস্তানের নাগরিক কি না সেই প্রশ্ন মুখ্য হয়ে যায়। ইসলামি প্রজাতন্ত্রের আংশিক পরিমার্জন করে যখন বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজন করা হয়, তখন হিন্দুরা তাদের নাগরিক মর্যাদার প্রশ্ন উত্থাপন করলে কী জবাব আছে রাষ্ট্রের কাছে? পাকিস্তান শাসনামলে যেমন ‘হিন্দু’দেরকে ভারতের এজেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করে বিভিন্ন স্থানে পোস্টার সাঁটিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হতো, নানা ধরনের গুজব সৃষ্টি করে হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নারীধর্ষণ, ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে বাড়িঘর ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়ন করে দখল করে নেওয়া হতো। বর্তমানেও ঠিকই একইভাবে আক্রমণের মঞ্চ নির্মাণের জন্য সেই পাকিস্তানি কায়দা আর ধর্মকে ব্যবহারের অপরাজনৈতিক দর্শনকেই বেছে নেওয়া হয় তখন আক্রান্তদের কাছে বাঙালির স্বাধীন জাতি রাষ্ট্রের ধারণা মূল্যহীন মনে হওয়া কী অস্বাভাবিক?

এখানে ধর্ম মাননা বা অবমননা করার বিষয়টি একটি অজুহাত মাত্র। ১৯৪৭ সাল থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশে যতগুলো সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে, সব ক্ষেত্রে ভারতকে টেনে আনা হয়েছে অথবা ধর্মের ইস্যুকে গুজব আকারে প্রচারণা করা হয়েছে। আর সব ক্ষেত্রে ওপরের প্রচারণা যা-ই থাকুক ভেতরের গল্প ছিল—রাজনীতি আর অর্থনীতি।

অনুরূপভাবে ভারতেও যখন রাজনৈতিক টার্ম কার্ড ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে, তখন মুসলমানের ঘরে ফ্রিজের মধ্যে ‘গরুর মাংস—এ ধরনের শক্তিশালী অস্ত্র ‘হেড অব দ্য প্যাক’ ইস্কাপনের টেক্কা বের করা হয়। এসবই আসলে ধর্মের নামে রাজনীতির খেলা। আর নির্বাচন সামনে এলে খুব সযতনে নিপুণ শিল্পের কারুকার্যে ইস্যুগুলো নির্মাণ করা হয়। সাধারণ মানুষের চোখে ধন্দে লাগে—কোনটি আসল আর কোনটি নকল। ফাঁকতালে যার যা উদ্দেশ্য তা হাসিল করে ঘরে ফেরে।

আমরা যত কথাই বলি না কেন, সাম্প্রতিক বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হিংসার যে ঘটনা ঘটেছে তার উত্স লুকিয়ে রয়েছে রাষ্ট্রের পরিকাঠামোর অন্তরালে। বঙ্গবন্ধু সংবিধান বানিয়েছিলেন দীর্ঘ সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের মৌলচেতনা আর বাঙালির অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিক মূল্যবোধের দর্শনকে অন্তর্ভুক্ত করে। ’৭৫-এ প্রথমে বঙ্গবন্ধুকে, এরপর বাহাত্তরে সংবিধানকে হত্যা করা হয়। নাগরিকদের মধ্যে তৈরি করা হয় সুস্পষ্ট বিভাজন। হাজার বছরের সংগ্রামের ফসল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিভক্ত করা হয় বাঙালি আর বাংলাদেশি পরিচয়ে।

বঙ্গবন্ধু ইসলামি ফাউন্ডেশন বানিয়েছিলেন নবি-রসুলের ইসলামচর্চা ও গবেষণার মাধ্যমে ধর্মের মানবিক নির্যাস মানুষের মধ্যে সঞ্চারিত করতে। ইসলামের নামে অন্ধকারের শক্তি যাতে মানুষকে কূপমণ্ডূক বানাতে না পারে, সে উদ্দেশ্য নিয়ে। শেখ হাসিনাও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিতদের হতাশা কাটাতে অকৃপণভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে চলেছেন। মডেল মসজিদ নির্মাণ করে দিচ্ছেন জেলায় জেলায়। এতত্সত্ত্বেও গলদ কোথায় যেন রয়েই গেছে। অধিকাংশের মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উদার চিন্তাকে ছাপিয়ে ধর্মীয় ‘স্কুল অব থট’ জিম্মি হয়ে আছে কিছু সাম্প্রদায়িক মানুষের হাতে। ইসলামের শাশ্বত ভাবনাকে কেন জানি তারা সামনে আনতে চায় না।

বাংলাদেশকে ঠিক করতে হলে প্রথমে তার সংবিধান ঠিক করতে হবে। মানুষকে মানুষ বানাতে হলে প্রথমে প্রাগ্রসর ও মানবিক শিক্ষা-কারিকুলাম বানাতে হবে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে উদারনৈতিক ধর্মীয় ও বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা বাড়াতে হবে। উগ্র-মৌলবাদকে রুখার নামে ধর্মকে প্রতিপক্ষ করা যাবে না। হাজার বছরের সংগ্রাম ত্যাগ-তিতিক্ষা আর ধর্ম-নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস সকল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জানার সুযোগ করে দিতে হবে। প্রতিরোধ নয়, প্রতিকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। সঠিক জনশিক্ষা আর ইতিবাচক জনমতই সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরু ধারণার ভেদরেখা মুছে ‘আমরা সবাই বাঙালি’—এই সাম্য আর সম্প্রীতির মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইত্তেফাক/এএএম

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন