বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

সংশয়হীন ভারতের জবরদস্ত প্রস্তুতি, চাপ বাড়াবে চীনের ওপর

আপডেট : ২৪ জুন ২০২০, ১১:৫৭

চীন-ভারত সীমান্তের লাদাখে দুই দেশের সেনা সমাবেশ, সমরসজ্জার প্রস্তুতি, উত্তেজনা প্রশমনের কৌশলপ্রিয় চেষ্টা, পাকিস্তানকে সামনে রেখে বেইজিংয়ের উসকানি, ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমারেখায় চীনা সেনার নিঃশব্দ বিচরণ—এরকম নানা ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের রাশিয়া সফর খুবই তাত্পর্যপূর্ণ।

রাজনাথ অভিজ্ঞ রাজনীতিক। ঠান্ডা মাথার নির্মেদ পুরুষ। ভাবমূর্তি তার স্বচ্ছ। রাশিয়ায় রওনা দেওয়ার প্রাক্কালে তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে দেশের সীমারক্ষার যে সঘন দৃঢ়তা ব্যক্ত করেছেন, তাতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ভারত বিনা যুদ্ধে তার সূচ্যগ্র মেদিনীও হাতছাড়া করবে না। আবার পশ্চিমের যে কোনো পরাশক্তির মুখাপেক্ষীও হতে চায় না। সীমান্তের উত্তেজনা রুখতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সর্বশেষ প্রস্তাব নিয়ে ভারত কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। তার মধ্যস্থতার আগের প্রস্তাবও পত্রপাট খারিজ করে দিয়েছিল। চীনও ট্রাম্পের অতি আগ্রহ উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, দুই দেশই তাদের সীমান্ত সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে সক্ষম। কিন্তু এ রকম দৃঢ়তা প্রকাশের পরেও লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ১৫ জুন নিরস্ত্র সংঘর্ষ বেঁধে গেল। উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি নগণ্য নয়। ভারত ফুঁসছে। জাতীয় আবেগ চওড়া করার একাংশের চেষ্টা অবিরত। যেমন পণ্য বয়কটের ডাকে, তেমনি লাদাখে, পাকিস্তানি সীমান্তে, অরুণাচল ও সিকিমের সীমান্তরেখায় কড়া নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তোলার জবরদস্ত প্রস্তুতিতে। প্রতিটি মুহূর্তে ভারত সতর্ক। অভ্যন্তরীণ তত্পরতা আর কূটনৈতিক চাপও সমানতালে চালিয়ে যেতে দিল্লি সংকল্পবদ্ধ।

জাতশত্রু চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকার লাগাতার অভিযোগে নতুনত্ব নেই। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্কের নববিন্যাস ও বাণিজ্যে দিল্লিকে অধিকতর সহযোগী বানিয়ে তোলা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের সবচেয়ে বড়ো প্রতিদ্বন্দ্বী এবং নিজের বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু হিসেবে স্থাপিত করা আমেরিকার একাগ্র লক্ষ্য। ভারত-মার্কিন প্রয়াসে দিল্লি কতটা সাড়া দেবে, বলা মুশকিল। করোনা নিয়ে লড়ছে। লড়াই তার জয়মুখী। কিন্তু অসমাপ্ত। এটা এক সমস্যা। এ সমস্যার ওপরে অতর্কিত যুদ্ধের হুমকি, হুমকির বিরুদ্ধে সব দলের ঐক্য প্রত্যাশিত। এরকম পরিস্থিতিতে মার্কিন হস্তক্ষেপকে ভারত বিশেষ আমল দেবে না। এটা তার রেওয়াজ নয়। কেননা কেনেডির মৃত্যুর পর থেকে আমেরিকা ভারতের নির্ভেজাল বন্ধু হতে পারেনি। ’৭১-এর যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের জন্মকালে আমেরিকার ভূমিকা স্বস্তিদায়ক ছিল না। শ্রীমতী গান্ধী সম্পর্কে ভূতপূর্ব মার্কিন বিদেশ সচিব কিসিঞ্জারের অশালীন কটূক্তি ভারত, বিশেষ করে জাতীয় কংগ্রেস ভুলতে পারেনি। ভিয়েতনামের যুদ্ধ, নির্জোট আন্দোলনে ভারতের নেতৃত্ব এবং অর্থ ও সমরাস্ত্র জুগিয়ে পাকিস্তানকে ক্ষমতামত্ত করে তোলার ঘোষিত-অঘোষিত কৌশল নেহরু-ইন্দিরা বা অটল বিহারির ভারত কখনো বরদাস্ত করেনি। পরবর্তী পর্বেও নয়াদিল্লি মার্কিন নীতি নিয়ে খানিকটা সংশয়াচ্ছন্ন। নরেন্দ্র মোদির আমলে দিল্লির প্রতি আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা আশাপ্রদ হলেও প্রশ্নহীন, স্বার্থহীন নয়।

ট্রাম্প নিজের ভোটের স্বার্থেও চীন বিরোধিতায় শান দিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত মার্কিনপুঁজি চীনের বাইরে অনুগত বন্ধুবাজার খুঁজছে। এ বাজার-সন্ধান ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারকে কতটা স্বস্তি দেবে? রুখতে পারবে চীনের পণ্য? সন্দেহ আছে। আমাদের বিশ্বাস—শান্তিপ্রিয়, ঘোষিতভাবে যুদ্ধবিরোধী ভারত প্ররোচনার ফাঁদে পা দেবে না। রেজিমেন্টেড চীন, স্বল্পভাষী চীন বাড়াবাড়ি করলে ভারত পিছিয়ে আসবে, হাত পা গুটিয়ে নেবে, এ রকম পিচ্ছিল দুর্বলতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ভারত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ—হামলার জবাবে অবশ্যই হামলা। দ্বিতীয়ত বেইজিংকে চাপে রাখতে আন্তর্জাতিক কূটনীতি বা তার পুনর্বিন্যাসকে অধিকতর গুরুত্ব দেবে। উপসাগরীয় অঞ্চল, পশ্চিম এশিয়া; উত্তর-পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় তার তত্পরতা ক্রমশ বাড়ছে। বাড়বে।

তিন দিনের রুশ সফরে রওনা দেওয়ার আগে রাজনাথ সিং বলেছেন, চীন যেভাবে আগ্রাসি মুখ দেখাচ্ছে তাতে ‘রুলস অব এনগেজমেন্ট’ ভারত বদলাতে বাধ্য। বদলের চেহারাটি কী? বেগতিক দেখলেই আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, পূর্ব লাদাখে প্রত্যাঘাতের সম্ভাবনা, বায়ুসেনার যুদ্ধকপ্টারের ওড়াউড়ি আর স্ট্র্যাটেজিক লোকেশনে জবরদস্ত টহলদারি এবং সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনভিত্তিক বলপ্রয়োগের পূর্ণ কর্তৃত্ব।

এরকম পরিস্থিতিতেই পুরোনো, পরীক্ষিত বন্ধুদেশ রাশিয়ায় গেলেন রাজনাথ। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের সব টেস্টে মস্কো উত্তীর্ণ। নির্জোট আন্দোলন থেকে কাশ্মীর সমস্যা, ’৬২-র ভারত-চীন যুদ্ধ, ’৬৫-র পাক-ভারতের মোকাবিলা, ’৭১-র বাংলাদেশের সশস্ত্র অভ্যুত্থান, ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে দিল্লির সদর্থক কূটনীতি—এ ধরনের প্রতিটি ঝুঁকিতে রাশিয়া নিঃশর্তে ভারতের সমর্থক।

চীনের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্ক কখনো মসৃণ ছিল না। আজও দ্বিধা কাটেনি। সম্প্রতি একটু রদবদল হয়েছে, ইরানকে ঘিরে। মস্কো, তেহরান ও বেইজিং মিত্রতার মঞ্চ নির্মাণের খসড়া তৈরির চেষ্টা করছিল। লক্ষ্য, মার্কিন বিরোধিতা এবং উপসাগরীয় অঞ্চল ও পশ্চিম এশিয়ায় ক্ষমতা বিস্তারের ভাগাভাগি। লক্ষণ এখনো পরিষ্কার নয়। দ্বিতীয়ত, ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার স্থায়ী সম্পর্কের সামনে এই তত্পরতা নস্যি।

আমাদের তিনটি বিষয় মনে রাখা দরকার। এক. সমাজতান্ত্রিক নেহরুর শিল্পায়ন আর শিল্পের জাতীয়করণের ভাববাদী আদর্শের অন্যতম বিদ্যাদাতার নাম রাশিয়া। দুই. ভারতকে সমরাস্ত্রে সমৃদ্ধ করে তোলার ক্ষেত্রে মস্কোর অবদান অনস্বীকার্য। তিন, একাত্তরে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের মুহূর্তে প্রায় গোটা বিশ্ব মার্কিন রক্তচক্ষুর ভয়ে কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের নিরাপদ অবস্থানের জন্য যখন নিশ্চুপ এবং ভারত প্রায় নিঃসঙ্গ, তখন রাশিয়া তার দিক বদল করেনি। এমন এক বন্ধুকে, ভারত সাম্প্রতিক উত্তেজনার মুহূর্তে আরো বেশি কাছে পেতে চাইবে না, তা কখনো কি সম্ভব?

ট্রাম্প যতই আগ বাড়িয়ে কথা বলার চেষ্টা করুক না কেন, রাশিয়ার সুপ্রতিষ্ঠিত ভাবমূর্তির চেয়ে আমেরিকার যান্ত্রিক হূদ্যতাকে ভারতের গণসত্তা অধিকতর গুরুত্ব দিতে পারে না। দেবে না। রাজনাথের এ সফর দুই দেশের সম্পর্কের মূল ও ডালপালাকে সম্ভবত আরো সবুজ আরো প্রত্যাশাময় করে তুলবে।

মাও সেতুংয়ের জীবদ্দশাতেই বেইজিং রাশিয়ার বিশ্বস্ততা হারিয়ে ফেলে, ঔপনিবেশিকতা ও পুঁজিলগ্নির প্রশ্নে। সমাজতন্ত্রকে ব্যবহার করে পুঁজিবাদের কাছে চীনের সার্বিক আত্মসমর্পণকে কমিউনিস্ট রাশিয়া সুনজরে দেখেনি। আবার সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার সাম্রাজ্য বিস্তারের ছল-কৌশলে মাও সেতুং ক্ষিপ্ত, বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। পুঁজির অবাধ সঞ্চয়, সমাজতন্ত্র থেকে বেইজিংয়ের আদর্শগত বিচ্যুতি একসময় দুই দেশের সম্পর্ককে কঠিন প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, ভারতের প্রতি চীনের আগ্রাসি আচরণও নব্য সাম্রাজ্যবাদের লক্ষণ বলে চিহ্নিত হতে থাকে।

সীমান্ত নিয়ে, চীনের আগ্রাসনি মতলব নিয়ে ভারত কখনো নিঃসন্দেহ হতে পারেনি। পঞ্চশীলের নীতিভিত্তিক নেহরু চুয়েন লাইয়ের শান্তি চুক্তির কয়েক বছরের মধ্যে, ’৫৯ সালে হঠাত্ দুই দেশের সদ্ভাবে সংশোধনহীন ভাঙন দেখা দেয়। ’৬২-তে ভারত আক্রমণের পেছনে মাও সেতুঙ্গের দৃষ্টিভঙ্গি আজও অজ্ঞাত। চুয়েন লাই তার প্রতিশ্রুতি থেকে সম্পূর্ণ সরে গেলেন। যা হওয়ার তা-ই ঘটল, অনিবার্য যুদ্ধ। তখনকার বিদেশমন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেনন কাশ্মীর থেকে একজন সেনাও সরাতে রাজি হননি; তার ধারণা ছিল, সুযোগ বুঝে হামলা করবে পাকিস্তান। মেনন ভাবতেন, চীনের সঙ্গে বিশেষ কোনো ঝামেলা হবে না। যুদ্ধের ঘনঘটা দেখেই সতর্ক হয়ে ওঠেন নেহরু। তার সম্পর্কে ভুল তথ্য পেশ করতে অনেকেই অভ্যস্ত। কিন্তু চীনকে তিনি কখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেননি। মৃত্যুর ৯ দিন আগে, ১৯৬৪ সালে, আকাশবাণীর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, চীন এশিয়ার একচ্ছত্র নেতৃত্ব দাবি করে এমন আচরণ করছে যে, দে আর দ্য টপ ডগ ইন এশিয়া। এরও বহু আগে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জে এফ কেনেডিকে দূরদৃষ্টিময় জহরলাল বলেছিলেন, ‘চীন কেবল এশিয়ার নয়, বিশ্বের নেতা হওয়ার চেষ্টা করছে। ভারতের জমি দখল তাদের লক্ষ্য নয়, প্রকৃত উদ্দেশ্য গায়ের জোরে ভারতের ওপর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া। নতুন পরিস্থিতিতে চীনের দুর্বোধ্য, কর্কশ মুখটি কি বদলে গেছে? মনে হয় না। বাণিজ্যনীতিতে, ক্ষমতামত্ততায়, অভ্যন্তরীণ দমনপীড়নে তার বহুদৃষ্টি আগের চেয়ে অনেক বেশি ধারালো। সংঘবদ্ধ। হাতে তার স্বৈরচারের চাবুক আর কাঁটা।

লেখক:ভারতীয় সাংবাদিক ও সম্পাদক, আরম্ভ পত্রিকা

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন