শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

‘আম্ফান ও আমকথা’

আপডেট : ৩০ জুন ২০২০, ০৯:৩৯

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের সুস্বাদু ফল পাওয়া যায়, যেমন—আপেল, বেদানা, তরমুজ, কলা, ফুটি—তালিকায় কী নেই? আর ভারতীয়দের কাছে সব থেকে প্রিয় ফল হলো আম, কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ‘আম্ফান’ ঘূর্ণিঝড়ের জন্য বাঙালি তথা ভারতীয়দের প্রিয় রসনার ফল আমের ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দরুন কোটি কোটি টাকার আম নষ্ট হয়ে গেছে, ফলে সাধারণ মানুষ আম থেকে বঞ্চিত।

বিশেষ করে পশ্চিম ভারতের মহারাষ্ট্রে ‘আলফানসো’ আমের বিশ্ববাজারে চাহিদা খুব বেশি। যদিও এ নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক আছে। সে বিষয়ে পরে আসছি।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা-মুর্শিদাবাদের আমের ২৮ রকম নামকরণ করেছিলেন, কয়েকটির নাম উল্লেখ করছি। যেমন—রানিপছন্দ, বেগমপছন্দ, বেগমফুলি, কোহিতুর ইত্যাদি ইত্যাদি।

মুর্শিদাবাদের ওপারে মালদায় ফজলি, হিমসাগর, ল্যাংড়া, চোষা—এসব আমেরও নামকরণ করেছিলেন মালদার আরেক নবাব (ছোট) খানচৌধুরী পরিবার। দেশভাগের পর অর্থাত্ ১৯৪৭ সালের পর মালদা জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকাটি পূর্ব বাংলায় চলে যায়। খানচৌধুরী পরিবারের উত্তরসূরি—চায়ের নিলামের মতো—একটি আম নিলাম কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। নিলামে আম বেচাকেনা হতো। এই নিলাম থেকেই ১০০ কোটি টাকা মূল্যের আম বছরে বাংলাসহ পৃথিবীর নানা দেশে যেত। এবার ‘আম্ফানের’ ফলে সেই আমের নিলাম বন্ধ হয়ে গেছে। নিলাম বন্ধ হয়েছে মমতা ক্ষমতায় আসার পরেই। ফলে আমচাষিরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের পরে যে সামান্য আম বেঁচে ছিল তা পাড়ার মতো শ্রমিক পাওয়া যায়নি করোনার ভয়ে। মালদার সাধারণ মানুষ মনে করে আম চাষ করে বছরে অন্তত তিন মাস তাদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা হতো। মালদার পরিযায়ী শ্রমিকরা দেশে ফিরে এলেও করোনার ভয়ে তারা আম পাড়েনি, ধরেওনি। গাছ থেকে পড়ে আম নষ্ট হয়ে গেছে।

আমার মনে আছে, আটের দশকের গোড়ায় ভারতের সাবেক রেলমন্ত্রী সরকারি কাজে বোম্বে গিয়েছিলেন। ভারতের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী সাংবাদিক রুশী করঞ্জিয়া তাকে তার বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। যেহেতু আমি ব্রিশ পত্রিকার পূর্বাঞ্চলের প্রতিনিধি ছিলাম তাই আমাকেও ঐ ভোজে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। শেষপাতে ছিল ‘আলফানসো’ আম, মন্ত্রী ও সম্পাদক দুজনই ছিলেন কড়া মেজাজের লোক। ‘আলফানসো’ আম যে বিশ্ববিখ্যাত তা করঞ্জিয়া বলতেই তিনি এ কথার প্রতিবাদ করে বলেন—এটা কোনো আমই নয়। সবচেয়ে ভালো আম মালদার হিমসাগর। যার সঙ্গে পৃথিবীর কোনো আমের তুলনা হয় না। মালদার হিমসাগর আর মহারাষ্ট্রের আলফানসো নিয়ে তর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, দুজনে প্রায় হাতাহাতির উপক্রম হয়। আমি মধ্যস্থতা করে মন্ত্রীকে বলেছিলাম, আপনার হিমসাগর ওনাকে পাঠিয়ে দিন।। মন্ত্রী রাজি হলেন। মাসখানেক পরে করঞ্জিয়াকে ৫০০ আম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। হিমসাগর খেয়ে করঞ্জিয়া রেলমন্ত্রীকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে আম নিয়ে তর্কে হেরে গেছি। Himsagor is the best Mango in our country.’এভাবেই তাদের বিতর্কের অবসান হলো।

শুধু এপ্রিল থেকে জুন নয়, নভেম্বর-ডিসেম্বরেও পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চলে আম পাকে। ২০১০ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হয়ে ল্যাটিন আমেরিকার কিউবার রাজধানী হাভানায় গিয়েছিলাম। রাতে হোটেলে পৌঁছেছিলাম। ভোর হতেই জানালা খুলে দেখলাম, আমি যে ঘরে ছিলাম তার পাশেই একটি গাছে প্রচুর আম পেকে ঝুলছে। লোভ সামলাতে পারিনি। দুটি আম ছিঁড়ে নিয়ে ভাবলাম আমি বোধহয় অন্যায় করলাম। দ্রুতবেগে আমি রিসেপশনে আম দুটো হাতে নিয়ে গিয়ে বললাম—আমি এই আম দুটো আপনাদের গাছ থেকে পেড়ে নিয়েছি। ওরা বলল—এগুলো আপনাদের জন্যই। আপনারা আমাদের অতিথি।

এবার দেখা যাক, পশ্চিমবঙ্গে আম্ফান ও করোনার ফলে আমের কেমন ক্ষতি হয়েছে। এবার বাঙালির পাতে ফলের রাজা আমের তেমন দেখা পাওয়া যাবে না বলেই বাজারে ছবি বলছে। যেসব জেলায় আমের ফলন বেশি হয় তার প্রায় পুরোটাই ক্ষতির মুখে পড়েছে, যেটুকুও-বা পাওয়া যাচ্ছে তার দামও আকাশছোঁয়া। আমচাষিদের বেশির ভাগই জানাচ্ছেন যে, তাদের ভিনরাজ্যের ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে।

উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বসিরহাট, বাদুড়িয়া ও স্বরূপনগরের বড় বড় আমবাগানের প্রায় সবই শেষ হয়ে গেছে। এবার আমের ফলন ভালো হবার জন্য আমচাষিরা খুশি হয়েছিলেন কিন্তু করোনা, আম্ফান, লকডাউনে আমচাষের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, অন্যবার বশিরহাটের আম কিলোপ্রতি ৩০-৪০ টাকায় মিলত কিন্তু এবার তা দাঁড়িয়েছে ১৮০-১৯০ টাকায়। তাও মেলা দায়। এছাড়াও শিলাবৃষ্টিতে ৬০ হাজার মেট্রিন টন আমের ক্ষতি আগেই হয়েছে।

আমের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে রাজ্য প্রশাসন সূত্রের খবর, বেশির ভাগ জেলাতেই কোনো সংযোগ ঠিক হয়নি। ফলে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে এখনো। সব তথ্য পেলে তবেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বোঝা যাবে।

লেখক :ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন