বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশেষজ্ঞমত

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা: করোনা এবং ভবিষ্যৎ

আপডেট : ৩০ জুন ২০২০, ১১:৫২

করোনা সংক্রমণে বিপর্যস্ত বিশ্বে আজ মানুষের জীবনযাপনের কিছু মৌলিক সূত্র, যেমন পারস্পরিক যোগাযোগ, সামাজিক, পারিবারিক বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদি পালন হয়ে পড়েছে কষ্টসাধ্য। এই নতুন বাস্তবতায় আমাদের জীবনাচরণ কেমন হবে তা এখনও বোঝা না গেলেও এটুকু নিশ্চিত যে, কার্যকরী ভ্যাক্সিন না আসা পর্যন্ত আমাদের জীবন আর পূর্বাবস্থায় ফিরছে না।

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে এই রূঢ় বাস্তবতা মেনে নিয়েই তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। সুপ্রিমকোর্টের নেতৃত্বে আমরা সম্প্রতি ভার্চুয়াল আদালতের অগ্রযাত্রা দেখেছি, তবে এই তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বিচার ব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন অনেকেই। ভার্চুয়াল আদালতের পক্ষের যুক্তিমতে, জনাকীর্ণ আদালতে বিচারক ও আইনজীবিসহ সংশ্লিষ্ট সকলেরই করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বেশি। আর বিরোধী যুক্তিমতে, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বিচারব্যবস্থার প্রায়োগিক দিকগুলো অধিকাংশ আইনজীবীদের অজানা থাকায় মুষ্টিমেয় ক’জন ব্যাতীত অধিকাংশের পক্ষেই ভার্চুয়াল আদালতে মামলা করা অসম্ভব।

একদিকে খোলা আদালতে করোনার ঝুঁকি, অন্যদিকে অধিকাংশ আইনজীবীর উপার্জনহীনতার হাহাকার – এই দ্বিমুখী সমস্যা থেকে আমরা কিভাবে বেরিয়ে আসবো?

এ ক্ষেত্রে, বিলাতের বিচারব্যবস্থার পারিবারিক ডিভিশনের প্রেসিডেন্ট স্যার এন্ড্রু ম্যাকফার্লেইন-এর উক্তি প্রণিধানযোগ্য -

'এটি অনুমানযোগ্য যে সামাজিক দূরত্ব অনেকদিন ধরে চলতে থাকবে এবং ২০২০ এর শেষ বা ২০২১ এর আগ পর্যন্ত আমাদের স্বাভাবিক আদালতের পরিবেশে যাওয়া সম্ভব হবেনা। আমাদের এই পরিবর্তন মাথায় রাখতে হবে, কারণ বিচার ব্যবস্থাপনায় এর প্রভাব পড়বে। একটি মামলা স্বল্প সময়ের জন্য মুলতবি করার যে যৌক্তিকতা আগে ছিল তা এই দীর্ঘ সময়ের আলোকে নতুন করে পুননির্ণয় করতে হবে। বিচারকার্যের পরিসমাপ্তির প্রয়োজনীয়তা, বিচারকার্যে বিলম্বতার বিরূপ প্রভাব, মামলা-মোকদ্দমার ক্রমবর্ধমান দীর্ঘ জট এবং সর্বোপরি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত সকল বিষয়সমূহ বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হওয়া বাঞ্ছনীয়।'

উপরের কথাগুলো বাংলাদেশের জন্যেও প্রযোজ্য বলে আমি মনে করি। জরুরি-ভিত্তিতে বস্তুনিষ্ঠ পদক্ষেপ না নিলে করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে আমাদের যে মামলাজট ছিল, বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে তা প্রকটতর আকার ধারন করবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরনের যে সাংবিধানিক গুরুদায়িত্ব, তাকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করতে যাওয়া এই সম্ভাবনা আমাদের কোনভাবেই কাম্য নয়।

দুর্যোগকালীন সময়ে ভার্চুয়াল আদালত একটি স্বল্পমেয়াদী সমাধান। তবে দীর্ঘমেয়াদে ভার্চুয়াল এবং স্বাভাবিক আদালতের একটি হাইব্রিড ব্যবস্থা চিন্তা করাই সমীচীন। আমাদের সামাজিক দূরত্বের প্রয়োজনীয়তা আরও বছরখানেক থাকতে পারে এবং এই সময়ে মামলার সংখ্যাও বেড়েই চলবে, এই দুইটি বাস্তবতা মেনে নিয়েই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে, মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে সময়ের সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা আমাদের সমাধানের একটি পথ হতে পারে, কেননা অধিকাংশ মামলাতেই অনর্থক এবং অযাচিত সময় নষ্ট এবং কালক্ষেপণ করা হয়। বিচারিক সময় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তাই আমার রয়েছে কিছু প্রস্তাবনা:

বিচার্য বিষয় স্পষ্টীকরণ

(ক) মামলার বিচার্য বিষয়সমূহ প্রতিদ্বন্দ্বী বিচারপ্রার্থীদের সম্মতি-সাপেক্ষে ঠিক করা। এক্ষেত্রে মামলা-মোকদ্দমার কার্যবিধি সংক্রান্ত আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ জরুরি।
(খ) মামলার বিচার্য বিষয়সমূহ, যতদূর সম্ভব (মৌখিক শুনানি অপরিহার্য না হলে) লিখিত সাবমিশন এবং কাগজপত্রের ভিত্তিতেই নির্ধারণ করা।
(গ) যে মামলায় মৌখিক শুনানি বা সাক্ষীগণের জেরা অপরিহার্য, সেক্ষেত্রে মৌখিক শুনানি বা সাক্ষীগণের জেরা ও বিচার্য বিষয়, নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ সাপেক্ষে সম্পন্ন করা।

শুনানির বিন্যাস

(ক) প্রতিটি শুনানির জন্য দিন-ভিত্তিক শুরু থেকে শেষ সময় বেঁধে দেয়া। এতে করে বিচারিক কাজে সময়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
(খ) যে সকল মামলায় মৌখিক শুনানি বা সাক্ষীগণের জেরা অপরিহার্য, সে রকম শুনানি - সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে - প্রতিদিন কয়টি এবং কোন সময়ে হবে সে সংক্রান্ত নোটিস পূর্বেই সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা। এতে করে আদালত প্রাঙ্গনে জনসমাগম নিয়ন্ত্রন করা যাবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে লিখিত সাবমিশন এবং কাগজপত্রের ভিত্তিতেই শুনানি সম্পন্ন করা।

বিচারিক সহযোগী নিয়োগ

উন্নত বিচারব্যবস্থায় বিচারিক সহযোগী তথা জুডিসিয়াল ক্লার্ক বা অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকে যারা মামলা সংক্রান্ত সকল কাগজপত্র বিশ্লেষণে বিচারককে সহযোগিতা করেন। পার্শ্ববর্তী ভারত এবং পাকিস্তানে প্রচলিত এই ব্যবস্থাটি বাংলাদেশেও প্রনয়ন করা হলে তা সময়-ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কার্যকর পন্থা হিসেবে কাজ করবে, বিশেষত সে সকল মামলায় যা শুধুমাত্র লিখিত সাবমিশন এবং কাগজপত্রের ভিত্তিতে সম্পন্ন করা যায়।

উপরের পরামর্শগুলো করোনাকালে দুটি উপকার করবে। প্রথমত, করোনার প্রাদুর্ভাব সত্ত্বেও বিচারের চাকা সচল থাকবে যা প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। দ্বিতীয়ত, সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনজীবীবৃন্দ যারা উপার্জনহীনতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের ভোগান্তি কমবে।

লেখক: সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবি ও ভার্টেক্স চেম্বারসের ম্যানেজিং পার্টনার।

ইত্তেফাক/আরএ

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন