আজ ৮ জুলাই। ২০১৫ সালের এই দিনে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনায় ডিউক মেডিকেল হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও বাংলাদেশে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের পথিকৃৎ মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ আহমদ খান চৌধুরী।
মানুষের জীবন জন্ম ও মৃত্যুশাসিত। এমন কেউ নেই যাকে মৃত্যু স্পর্শ করে না। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে ‘কুল্লু নাফসিন জায়কাতুল মাউত’ অর্থ্যৎ ‘প্রত্যেক আত্মা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।’ মানুষ যেমন নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসেনি, তেমনি নিজের ইচ্ছায় সে এ পৃথিবী ছেড়ে যেতেও পারে না। তাকে অবশ্যই আল্লাহতায়ালার অমোঘ নিয়তির নির্দেশ মানতে হবে। কিন্তু মানুষ ইচ্ছে করলে মৃত্যকে জয় করতে পারে। মানুষ চায়লে বেঁচে থাকতে পারে শত শত বছর ধরে। আর শত শত বছর বেঁচে থাকার জন্য তার প্রয়োজন হবে এমন কিছু কর্ম করে পৃথিবীতে রেখে যাওয়া যেগুলোর ধ্বংশ বা বিলয় নেই।
ইতিহাস পাঠে জানা যায়, পৃথিবীতে মহামানবেরা যে অনন্ত জীবন লাভ করেছেন তাদের সেই পরিচয়ের মূলে রয়েছে তাদের কর্ম ও সৃষ্টি। মানুষের জন্য যারা কাজ করেন তারাই অমরত্ব লাভ করেন। তেমনি এক অমরত্ব লাভকারী হলেন দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও বাংলাদেশে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের পথিকৃৎ মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ আহমদ খান চৌধুরী। তিনিও আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন এই বাংলাদেশ যতদিন থাকবে। আজ আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাকে স্মরণ করছি।
উত্তরবঙ্গের নাটোর জেলার সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারে ১৯৩৯ সালের ১০ নভেম্বর তার জন্ম। তার বাবার নাম আলী কাশেম খান চৌধুরী ও মাতার নাম আমাতুর রহমান। ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটে তার শিক্ষা জীবন শুরু। পরবর্তীকালে অস্ট্রেলিয়ান স্টাফ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। কর্মজীবনে তিনি সুনামের সাথে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮১ সালে মেজর জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ‘দারিদ্র্য ও ক্ষুধাকে জীবনের অভিশাপ’ মনে করেন। যার ফলে তার লক্ষ্য ছিল ‘লাভজনক ব্যবসায়িক কার্যক্রমের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিপূর্বক মানুষের মর্যাদা ও আত্মসম্মান বৃদ্ধি করা’। এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখেই তিনি ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেন। আর এতে তিনি শতভাগ সফলও হয়েছেন। ব্যবসায় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১০ সালে তিনি ডিএইচএল- দ্যা ডেইলি স্টার- বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ড কর্তৃক ‘বিজনেস পারসন অব দি ইয়ার’ হিসেবে পুরস্কৃত হন।
তিনি মেট্টোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই), ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসসি), ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড, বাংলাদেশ ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন সংগঠনের সভাপতি, পরিচালকসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব), বাংলাদেশ এগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা), আন্ডারপ্রিভিলেজড চিলড্রেনস এডুকেশন প্রোগ্রাম (ইউসেপ) প্রভৃতি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্য তিনি ছিলেন আইডল ব্যক্তিত্ব। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পের অগ্রদূত হিসেবে যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সকলের প্রাণ জুড়ে। তার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শোকবার্তায় শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আওয়ামীলীগ সরকার বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ গড়ার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা অর্জনে আমজাদ খান চৌধুরীর পদক্ষেপ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।’
আমজাদ খান চৌধুরীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার ছোট ভাই বশির খান চৌধুরী বলেন, আমজাদ খান চৌধুরী তার বাবা, মা, ভাই, বোনসহ পরিবারের সবাইকে অনেক ভালোবাসতেন। তিনি অনেক পড়ালেখা করতেন এবং খাবারের খুব শখ ছিল তার। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে সর্বশেষ যখন আমজাদ খান চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তখন বুকে জড়িয়ে ধরে আমাকে আদর করেন এবং তার (আমজাদ খান চৌধুরী) সন্তানদের বলেছিলেন, আমার ভাইদের সঙ্গে তোমরা কখনো বেয়াদবি করো না। তিনি আরো বলেন, সর্বশেষ মৃত্যুর দুই ঘণ্টা আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাকে ফোন করেন আমাজাদ খান চৌধুরী। এসময় তিনি বলেন, টেক কেয়ার ইউরসেলফ, আই এম ভেরি সিক। তোমার সঙ্গে হয়তো আর দেখা হবে না।
দেশের সমস্যা কি? এক কথায় বড় ভাই আমজাদ খান চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি আমাকে বলেছিলেন, কর্মসংস্থান সমস্যাই দেশের বড় সমস্যা। কর্মসংস্থান সমস্যার সমাধান করতে পারলে দেশে দারিদ্রতা কমে যাবে। কোন দিন বড় ভাইয়ের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি এমনকি মনোমালিন্য হয়নি জানিয়ে বশির খান চৌধুরী বলেন, সব সময় তিনি পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে থাকার পরামর্শ দিতেন। (সূত্র জাগো নিউজ)
বাবার স্মৃতিচারণ করে আমজাদ খান চৌধুরীর ছোট ছেলে বর্তমান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান খান চৌধুরী বলেন, বাবা বলতেন যখন কেউ জিজ্ঞাসা করবে বাড়ি কোথায়? তখন বলবে রাজশাহীর নাটোরে। বাবা যেটা শেখানোর চেষ্টা করেছেন তা হলো, বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসা। তিনি বলেন, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। অনেক কাজ বাকি আছে। ৪০ বছর বয়সে বাবা ব্যবসা শুরু করেছিলেন। বাবার কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছি ২৫ বছর ধরে। এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে সামনে এগিয়ে যাবো। বাবার অনেকগুলো অসমাপ্ত কাজ রয়েছে। সেসব বাস্তবায়নে কাজ করে যাবো। তিনি আরো বলেন, সবে মাত্র যাত্রা শুরু করেছি। অনেক পথ বাকি। দেশে অসংখ্য জেনারেল আমজাদ সাহেবের প্রয়োজন রয়েছে। (সূত্র জাগো নিউজ)
মৃত্যুর আগে কাউকে না জানিয়ে এই মহৎ ব্যক্তিটি তার দু’টি চোখ দান করে গেছেন। যেহেতু অনেক কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তাই তার স্মৃতিচারণে বলছি যে, ব্যক্তি জীবনে তিনি একজন সৎ ও ধার্মিক মানুষ ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়, নিয়মিত পবিত্র কুরআন পাঠ, জামে মসজিদে এসে নিয়মিত জুমার নামাজ আদায় এবং রমজানের রোজা রাখতেন। এক কথায় খাঁটি ও ইসলামী ধর্মীয় অনুশাসন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালনের সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। ছোটদের প্রতি তার ছিল অগাধ ¯েœহ ভালোবাসা।
ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে অনেক ভালোবাসতাম। তার বাড়িতে যখনই গিয়েছি বড় ¯েœহের সাথে হাস্যজ্জল চেহারায় আমাকে বলতেন ‘ইয়ং ম্যান’ কেমন আছেন। পরিবারের খোঁজ খবর নিতেন। মৃত্যুর কয়েক মাস পূর্বে আমার একটি বই উপহার দেয়ার জন্য গিয়েছিলাম তার বাড়িতে। বইটি হাতে নিয়ে তিনি খুবই খুশি হয়েছিলেন। বইয়ের বিষয়বস্তু জানতে চান এবং কথা বলেন বিভিন্ন বিষয়ে এবং জানতে চান কেমন কাটছে দিনকাল।
আসলে কিছু এমন মানুষ থাকেন যারা ইহধাম ত্যাগ করার পরও মানুষের প্রাণে চিরদিন বেঁচে থাকেন তেমনি শিল্প প্রতিষ্ঠানের অগ্রদূত আমজাদ আহমদ খান চৌধুরীও দেশের সীমানা পেরিয়ে যে খ্যাতি অর্জন করেছেন তার জন্য তিনি বেঁচে আছেন এবং থাকবেন কোটি হৃদয়ের প্রাণে।
ইহধাম ত্যাগের এ দিনে আমরা তার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
লেখক: ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট