শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

নাগরিক মতামত

এশিয়া প্যাসিফিকে মুখোমুখি আমেরিকা ও চীন

আপডেট : ০৯ জুলাই ২০২০, ০৯:৪৬

এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার ক্রমবর্ধমান সামরিক উত্তাপ যেন সহসাই বৈশ্বিক উত্তেজনার কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে। বস্তুত দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও চীনের মধ্যকার বহুমাত্রিক বিরোধের জেরে সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। প্রথমত মতাদর্শিক বিরোধ, এছাড়াও দক্ষিণ চীন সাগরের সার্বভৌম বিরোধ, আন্তঃকোরিয়া বিরোধ, হংকং পরিস্থিতি ও তাইওয়ানের সম্ভাব্য পরিণতিসংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুতে আমেরিকা ও চীন দীর্ঘকাল থেকেই মুখোমুখি অবস্থানে আছে। অন্যদিকে এসব ইস্যুকে লক্ষ্য বানিয়ে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকার সামরিক সক্ষমতার অব্যাহত প্রদর্শনীতে বরাবর ক্ষিপ্ত চীন। এরকম সমীকরণের মধ্যেই গত পহেলা জুলাই দক্ষিণ চীন সাগরের পার্সেল দ্বীপপুঞ্জে পাঁচ দিনব্যাপী নৌ-মহড়া শুরু করে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি। ঐ সময়ের কিছু আগে আমেরিকার তিনটি বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস থিওডর রুজভেল্ট, রোনাল্ড রিগ্যান ও নিমিটস সপ্তাহব্যাপী দাপিয়ে বেড়ায় প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন অংশে। অবশ্য এর মাত্র কয়েক দিন আগে চীনের কয়েকটি জঙ্গি বিমান দুই মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো তাইওয়ানের আকাশসীমায় মহড়া চালায়। তবে এবার চীনের সুখোই-৩০ বিমানগুলো কিছুটা বাধার সম্মুখীন হয়। এ সময় সৃষ্টি হয় একধরনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি।

তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, স্বল্প সময়ের ঐ উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে তাইওয়ানের আকাশসীমায় একটি মার্কিন বিমান উড্ডয়নের সংবাদ পাওয়া যায়। এই ঘটনা সত্য হলে সেটি হবে তাইওয়ানসংক্রান্ত চীন-মার্কিন বিরোধ বৃদ্ধির সুস্পষ্ট উদাহরণ। অন্যদিকে চীন কর্তৃক হংকংয়ের নতুন আইনের চূড়ান্ত অনুমোদন, উত্তর কোরিয়া কর্তৃক আন্তঃকোরীয় সংলাপ স্থগিতের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট লিয়াজোঁ অফিস গুঁড়িয়ে দক্ষিণ সীমান্তে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন ইত্যাদি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সামরিক উত্তাপের রেশ ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে বিভিন্ন মাত্রার বাগ্যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা ও চীন। এরমধ্যেই গত ২৫ জুন মস্কোর উত্তর কোরীয় দূতাবাস নিজেদের আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু সক্ষমতার বিস্তৃত বিবরণ তুলে ধরে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। ঐ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয় যে, প্রয়োজনে আমেরিকার সর্বত্র পরমাণু হামলার সক্ষমতা উত্তর কোরিয়ার আছে। এধরনের ঘটনাবলী এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সামরিক সমীকরণকে ক্রমশ আরো জটিলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যে কারণে তৈরি হচ্ছে যুদ্ধের আশঙ্কা। করোনায় বিপর্যস্ত দুনিয়ার বুকে এ ধরনের যুদ্ধের শঙ্কা সারা বিশ্বের জন্যই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে এ ধরনের যুদ্ধের সূত্রপাত ভেঙে দিতে পারে বৈশ্বিক স্থিতাবস্থা। যার ভয়াবহতা হবে খুবই মারাত্মক।

আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য সময় ধরেই বিরাজমান আমেরিকা ও চীনের দ্বিপাক্ষিক দ্বন্দ্ব। মূলত দুটি ভিন্ন ধারার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রস্থল সমাজতান্ত্রিক চীন ও পুঁজিবাদী আমেরিকার ঐতিহাসিক বিরোধের প্রাথমিক ভিত্তিই হচ্ছে মতাদর্শগত। যে কারণে বিশ্লেষকরা সব সময় মনে করেন দুটি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রার ভালো সম্পর্ক আনয়ন কখনই সম্ভব নয়। তবে দুটি দেশের মধ্যকার সম্পর্ক যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক থাকলে সেটি উভয় দেশের জনগণ ও বাকি বিশ্বের জন্যও মঙ্গলজনক হবে। এই সূত্রেই সমাজতান্ত্রিক চীনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক প্রায় আট দশক যাবত্ নানা মাত্রার টানাপড়েন সত্ত্বেও একধরনের স্বাভাবিকতা ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এই স্বাভাবিকতার মারাত্মক ছন্দ পতন ঘটে। দুই দেশের মধ্যকার রাজনৈতিক বিরোধ সহসা সামরিক সংঘাতের নানা ক্ষেত্র উন্মোচন করে। এর প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয় চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সামরিক উত্থান। এর ফলে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় বেইজিংয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রভাব পড়ে। একই সঙ্গে বহির্বিশ্বেও দেশটির প্রভাব বৃদ্ধি পেলে বেড়ে যায় আমেরিকার দুশ্চিন্তা। এই বাস্তবতার মধ্যে গত দুই দশক ধরে দক্ষিণ চীন সাগরের জলসীমাসংক্রান্ত বিষয়ে চীনের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরোধ নতুন মাত্রা পায়। এ সময়গুলোয় আমেরিকা তার এশিয়া প্যাসিফিকসংক্রান্ত সামগ্রিক নীতিতে আমূল পরিবর্তন আনে। আর এই পরিবর্তনের একমাত্র লক্ষ্যই হয় চীনের ক্ষমতাপ্রবাহের গতি শিথিল করে নিজের আঞ্চলিক সক্ষমতা অব্যাহত রাখা।

পরিবর্তিত মার্কিননীতির আলোকেই দক্ষিণ চীন সাগরের উপকূলীয় দেশগুলোর সঙ্গে আমেরিকার সখ্য ও মৈত্রী জোরালো হয়। ফলে চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন দক্ষিণ চীন সাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার সার্বভৌমত্ব দাবির পক্ষে সোচ্চার হয় আমেরিকা। এই সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য পূরণে আমেরিকা নিজের ঐতিহাসিক এক পরাজয়ের স্মৃতিবিজড়িত অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে সেখানে অস্ত্র সরবরাহের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। একই সঙ্গে ভিয়েতনামের সঙ্গে নানা মাত্রার নিরাপত্তা সহযোগিতার পথ সুগম করে। আমেরিকার এরকম তত্পরতার বিপরীতে চীনও পাল্টা উদ্যোগ গ্রহণ করে সমীকরণের ভারসাম্য বজায় রাখে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সক্ষমতা এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সমীকরণে চীনকে এগিয়ে নিয়ে যায়, যে ঘটনার পাল্টা কোনো ব্যবস্থা আমেরিকার হাতে নেই। ফলে এশিয়া প্যাসিফিকে আমেরিকার জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি অনিবার্য হয়ে ওঠে। এই সূত্র ধরেই ২০১২ সালে সিঙ্গাপুরের সাংগ্রিলা নিরাপত্তা সম্মেলনে খোলামেলাভাবে আলোচিত হয় এশিয়া প্যাসিফিক-সংক্রান্ত নতুন মার্কিন নীতি। ঐ সম্মেলনেই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ২০১৮ সাল নাগাদ আমেরিকা নিজের নেভাল সক্ষমতার ৬০ শতাংশ এশিয়া প্যাসিফিকে মোতায়েন করবে। আমেরিকার এই পরিকল্পনা চীনের জন্য সর্বাত্মক হুমকি হিসেবে দেখা হয়। সংগত কারণেই আমেরিকার এশিয়া প্যাসিফিক সংক্রান্ত পরিকল্পনার বিপরীতে চীন নিজের সামরিক নীতি ঢেলে সাজায়। ফলে ঐ বছরই চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে মিত্রদেশগুলোকে নিয়ে বেইজিংয়ে আয়োজন করা হয় এশিয়া নিরাপত্তা সম্মেলন। মূলত সাংগ্রিলা নিরাপত্তা সম্মেলনের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীন ও রাশিয়া সম্মিলিতভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তাসংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। তখনই উল্লিখিত দুটি দেশ চীন ও রাশিয়া এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সামরিক সহযোগিতাসংক্রান্ত চারটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, যেখানে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করা ও সাবমেরিন মোতায়েন গুরুত্ব পায়। এছাড়া দুটি দেশ আমেরিকাকে মোকাবিলায় এশিয়া প্যাসিফিকে জয়েন্ট সি নামক নিয়মিত নৌ মহড়া আয়োজনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে জয়েন্ট সি নামক চীন-রাশিয়ার যৌথ নৌ মহড়া সম্পন্ন হয়। ওপরের আলোচনায় এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সামরিক সমীকরণে একটি চিত্র পাওয়া যায়। এই আলোকে সেখানকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হলে চলমান উত্তেজনার শেষ লক্ষ্য হিসেবে যুদ্ধের আশঙ্কা অমূলক নয়। যে কোনো মুহূর্তে হতে পারে যুদ্ধের সূচনা।

এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হচ্ছে বিশ্বের সর্বাধিক সামরিক ঝুঁকিপূর্ণ কোরিয়ান পেনিনসুলা। আন্তঃকোরিয়া বিরোধের জেরে দীর্ঘকাল থেকেই এখানে আমেরিকা ও চীন পরস্পরের মুখোমুখি। এই অঞ্চলে আমেরিকার স্বার্থের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অন্যদিকে চীনের সুপ্ত অভিপ্রায় হচ্ছে যে কোনো মূল্যে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্যদের হটিয়ে আঞ্চলিক পর্যায়ে মার্কিন আধিপত্যের চূড়ান্ত অবসান। এই সূত্র ধরে উত্তর কোরিয়াকে ব্যাপকভাবে সামরিক সজ্জিত করে বেইজিং কার্যত আমেরিকার ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে আঞ্চলিক শক্তিব্যবস্থায় প্রচলিত-অপ্রচলিত যুদ্ধ সমীকরণের গুরুতর পরিবর্তন ঘটায় আমেরিকা নিজের নীতিতে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়। এক্ষেত্রে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির চারটি অগ্রাধিকার প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাধীনতা সার্বভৌত্ব অক্ষুণ্ন রাখার প্রত্যয় সাম্প্রতিক সময়ে মারাত্মকভাবে হোঁচট খাওয়ায় দেশটির সামনে আঞ্চলিক আধিপত্য ধরে রাখার একমাত্র উপায় হিসেবে এখানে জাতীয় শক্তির অতিরিক্ত সমাবেশ জরুরি হয়ে পড়ে। তাই এশিয়া প্যাসিফিকে আজকের উত্তেজনা আমেরিকা, চীন ও তাদের মিত্রদের মধ্যকার স্থায়ী বিরোধের চূড়ান্ত ধাপ অতিক্রম করছে বলে ধরে নেওয়া যায়, যেখানে চীন তার অভিষ্ঠ লক্ষ্য পূরণের চূড়ান্ত চেষ্টার অংশ হিসেবে সব ঝুঁকি নেওয়ার প্রস্তুতি শেষ করেছে। অন্যদিকে আমেরিকাকে লড়তে হচ্ছে নিজের অবস্থান ধরে রাখার লক্ষ্যে। এর শেষ পরিণতি দুনিয়ায় প্রচলিত কিংবা অপ্রচলিত যুদ্ধের সূচনা করতে পারে।

লেখক :বিশ্লেষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন